সেলিনা আক্তার
খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। দশ থেকে পনের বছর আগেও আইসিটি বা তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে একচেটিয়া বিচরণ ছিল পুরুষদের। মূল কারণ কম্পিউটার তথা আইসিটি খাতে শিক্ষা,
সেবা ও ব্যবসায় যারা নিয়োজিত ছিলেন, তাদের বেশিরভাগই ছিলেন পুরুষ। কিন্তু এখন আর সে অবস্থা নেই। দ্রুতই পাল্টে যাচ্ছে এ চিত্র। বাংলাদেশের নারীরা এগিয়ে এসেছেন তথ্যপ্রযুক্তিতে।
যদিও পোশাক শিল্প, চিকিৎসাসেবা, শিক্ষকতা, গবেষণা, ব্যাংকিংসহ অন্যান্য খাতে নারীর পদচারণা তুলনামূলকভাবে আগে থেকেই অনেক বেড়েছে।
বাংলাদেশে মোট কর্মসংস্থানের শতকরা প্রায় ১০ ভাগ তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত। তবে এ সংখ্যা ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। এ প্রেক্ষাপটে নারীর অবস্থান কম হওয়াই স্বাভাবিক।
আশার কথা, নারীরা এ খাতে নিজেদের যোগ্যতায় এগিয়ে যাচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সরকারের বিভিন্ন সময়োপযোগী উদ্যোগের ফলে কম্পিউটার বিজ্ঞান
ও টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলের মতো বিষয়গুলোতে নারীদের পদচারণা ধীরে ধীরে বাড়ছে। আইসিটি খাতে নারীদের সম্ভবনা যথেষ্ট।
বিশেষ করে উন্নত বিশ্বের তুলনায় উন্নয়নশীল দেশে এ সুযোগের সম্ভাবনা আরও বেশি।
কারণ অর্থনীতিতে তুলনামূলক পিছিয়ে থাকা দেশের নারীরা আইসিটি খাতের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার গুরুত্ব বুঝতে পারছেন এবং এ খাতেই কর্মজীবন ও পেশাজীবন গড়ার দিকে এগিয়ে চলেছেন।
বিশ্বের প্রায় সব দেশেই কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে তৈরি হচ্ছে প্রচুর কর্মসংস্থান। পশ্চিমা উন্নত দেশগুলোতেও উচ্চ প্রযুক্তির দক্ষ কর্মীর যথেষ্ট অভাব রয়েছে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, দিন দিন বিশ্বে আইসিটির বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ। ইন্টারনেট ব্যবহারেও পিছিয়ে নেই নারীরা।
ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ১৬ থেকে ৫৪ বছর বয়সী ইন্টারনেট ব্যবহারকারী নারী ও পুরুষদের সংখ্যা প্রায় সমান। কাজেই আইসিটি খাতে ওয়েবভিত্তিক অনেক কাজ আছে যেগুলো ঘরে বসেই করা যায়।
যেহেতু ইন্টারনেট ব্যবহারে পিছিয়ে নেই নারীরা, তাই এ ধরনের কাজ করার সুযোগ নারীদেরই বেশি।
তথ্যপ্রযুক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো ও নারী সচেতনতার জন্য বেশকিছু পদক্ষেপও নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় মহিলা সংস্থার একটি প্রকল্প ‘জেলাভিত্তিক মহিলা কম্পিউটার প্রশিক্ষণ’। এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হলো গ্রামীণ নারীদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ
এবং তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষার মাধ্যমে কর্মসংস্থান এবং যোগাযোগ প্রযুক্তিনির্ভর উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা।
জাতীয় মহিলা সংস্থার একটি প্রকল্প ‘তথ্য আপা’। তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন প্রকল্প এটি। প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য নারীর ক্ষমতায়নে তাকে তথ্য দিয়ে সমৃদ্ধ করা।
তথ্য ও জ্ঞানের রাজ্যে নারীর সহজ প্রবেশ নিশ্চিত করবে তথ্যপ্রযুক্তির হালনাগাদ ব্যবহার। প্রকল্পের প্রধান লক্ষ্য একটি ডিজিটাল তথ্যভান্ডার সৃষ্টি,
যেখানে সর্বস্তরের নারীর প্রবেশ ও তথ্য পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত হবে।
সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়েও আইসিটিতে নারীদের সম্পৃক্ততা বাড়ানোর জন্য কাজ চলছে। তথ্যকল্যাণী বা ইনফো-লেডি প্রকল্প ব্যাপক সাড়াও ফেলেছে সাধারণ মানুষের মধ্যে।
সাইকেল চালিয়ে একজন তরুণী মানুষের বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন। সঙ্গে ল্যাপটপ বা নেটবুক। ইন্টারনেটের মাধ্যমে তিনি কখনও স্বাস্থ্য সেবা দেন,
আবার কখনও গ্রামের মেয়েদের বা স্কুলের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের কম্পিউটার ব্যবহার শেখান। এদের নাম ‘ইনফো-লেডি’ বা ‘তথ্যকল্যাণী’।
তথ্যকল্যাণীরা তথ্য প্রযুক্তিভিত্তিক সেবাকে নিয়ে যাচ্ছেন সরাসরি গ্রামীণ জনগণের দোড়গোড়ায়। নানা বাধা পেরিয়েও দেশের আইসিটি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখা নারীর সংখ্যাও কিন্তু কম নয়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নিয়োজিত নারীরা নিজেদের অবস্থা সুসংগঠিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তুলছেন। বাংলাদেশেও গড়ে ওঠছে এমন সংগঠন যার নাম ‘বাংলাদেশ উইমেন ইন টেকনোলজি’ বা (বিডব্লিউআইটি)।
সংগঠনটির নারীরা কোন না কোনোভাবে বাংলাদেশের আইসিটি খাতের সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশে প্রযুক্তি খাতে পেশাগতভাবে জড়িত নারীদের এখন পর্যন্ত প্রধান সংগঠন এটি।
সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য আইটি খাতের সঙ্গে জড়িত নারীদের একত্রিত করে তাদের পরিচিতির ব্যবস্থা করা। সঙ্গে সঙ্গে তাদের জন্য নতুন নতুন সুযোগ তৈরি করা।
সংগঠনটি তরুণীদের তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে এবং এই শিল্পে উদ্যোগী হতে উৎসাহিত করে থাকে।
নারী উদ্যোক্তা এবং পেশাজীবীদের আইসিটিতে সাফল্য অর্জনের জন্য নেতৃত্ব গুণাবলীসহ অন্যান্য দক্ষতা বাড়ানোর সর্বাত্মক চেষ্টাও করা হয় এই সংগঠনটির পক্ষ থেকে।
কাজেই যে নারীরা বাংলাদেশের আইসিটি খাতের সঙ্গে যুক্ত তারা খুব সহজেই বিডব্লিউআইটির সদস্য হতে পারেন।
তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নারীদের আরও এগিয়ে আসার জন্য জনসচেতনতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন। যাতে কারিগরি জ্ঞান এবং বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিয়ে নারীরাও পুরুষের সমানতালে কাজ করতে পারে।
বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অল্প শিক্ষিত নারীরাও কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিয়ে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ওয়েব সাইট ডেভেলপমেন্টসহ বিভিন্ন কাজে সফল হচ্ছেন।
নারীর পূর্ণ ক্ষমতায়ন প্রযুক্তি জ্ঞান ছাড়া সম্ভব হবে না। এর জন্য আইসিটি খাতে নারীদেরকে এগিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
আমাদের দেশের জনসংখ্যা অর্ধেক নারী।
এই বিশাল জনশক্তিকে প্রযুক্তির জ্ঞানে প্রশিক্ষিত করতে পারলে তারা আমাদের বোঝা হবে না তারা হবে দেশের সম্পদ। আমাদের দেশে এখনও অনেক নারী ঘর থেকে বের হতে চায় না।
তাদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দিতে পারলে ইন্টারনেটের মাধ্যমে নিজের ঘরে বসে আউট সোর্সিং ও ফ্রিলানসিং করে ভালো উপার্জন করতে পারবে।
স্বল্প শিক্ষিত নারীদের সামান্য প্রশিক্ষণ দিতে পারলে ভালো একটি সফলতা পাওয়া যাবে।
আমাদের দেশে গ্রাম-গঞ্জের পিছিয়ে পড়া শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত নারীদের আইসিটি খাতে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তাদের হাতকে কাজে লাগাতে হবে।
সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাকেও এগিয়ে আসতে হবে। তাহলে আগামীতে আমাদের জাতীয় উন্নয়নে নারীর সাফল্য পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাবে।
জাতীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির বাড়বে। নারীদের উন্নয়ন করতে হলে এখনই আইসিটি খাতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। আর বর্তমানে যুগে আইসিটি খাতের উন্নয়ন ছাড়া উন্নত দেশগুলোর সাথে তালমিলিয়ে চলা সম্ভব নয়।
আইসিটি খাতে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারলে সামাজিক ধ্যান-ধারণা ও ধর্মীয় গোঁড়ামি অনেকাংশে কমে আসবে।
নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করতে হলে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নারীর অংশগ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।
সাম্প্রতিক সময়ে তথ্য প্রযুক্তির বিপ্লব চলছে দেশে। তরুণ সমাজ এখন সামজিক সাইটের মাধ্যমে তথ্যের আদান প্রদান করছে। গ্রামীণ নারীদের আইসিটি খাতে বিনামূল্যে প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার।
সরকারের এ উদ্যোগকে সফল করতে আমাদের প্রত্যেকের ভূমিকা রয়েছে।