ওয়াসিম ফারুক
প্রায় আড়াই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয়েছিল আমাদের স্বাধীনতা।পেয়েছিলাম লাল-সবুজের পতাকা পেয়েছিলাম বাংলাদেশ। সেদিন দেশমাতৃকার ইজ্জত সম্মান রক্ষায় স্বাধীনতার অর্জনের জন্য বর্বর ইয়াহিয়া বাহিনীর কাছে সম্ভ্রম উৎসর্গ করে ছিলেন আমাদের মা বোনরা। কিন্তু আমরা হতভাগারা হতভাগাই রয়ে গেছি। স্বাধীনতার চার যুগ পরে ও বর্বর ইয়াহিয়ার পেতাত্মা আমাদের পিছু ছাড়েনি।
ইয়াহিয়ার পেতাত্মা আরো শক্ত হয়ে জেকে বসেছে আামাদের ঘাড়ে। আজও প্রতিদিন ই দেশের কোথাও না কোথাও ধর্ষনের শিকার হতে হচ্ছে আমাদের মা-বোনদের। ধর্ষিতার আত্মচিৎকারে ভারী হচ্ছে বাংলার আকাশ-বাতাস। গত ৫ ডিসেম্বর ২০২০ ক্লাশ শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে বান্ধবীর বাসা ঢাকা সেনানিবাসের শেওড়া এলাকায় যাওয়ার পথে কুর্মিটোলা বাসস্টপের পাশের রাস্তার পাশেই ধর্ষনের শিকার হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী।
সংবাদ মাধ্যমে ধর্ষিতার বর্ননা অনুযায়ী মানব রুপের একজন জানোয়ার ই এই ঘটনা ঘটিয়েছে । রুমালে চেতনানাশক দ্রব্য মিশিয়ে নাকে চেপে ধরে মেয়েটিকে অজ্ঞান করে তার উপর নির্যাতন চালায় ঐ জানোয়ারটি। এই ধর্ষনের ঘটনা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা সহ দেশের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ই উত্তপ্ত। সহপার্টি ধর্ষনের শিকার হওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালের শিক্ষার্থীরা সহ বেশ কিছু সংগঠন মানববন্ধন ও প্রতিবাদ মিছিল সহ নানান ধরনের কর্মসুচী পালন করছেন।
বিক্ষোভকারীরা অবিলম্বে ধর্ষককে গ্রেপ্তার ও কঠিন শাস্তির দাবি জানাচ্ছেন। আমি যখন এই লেখা লিখছি তখন ধর্ষক গ্রেপ্তার হয়েছে। কিন্তু অপরাধীর অপরাধের কঠিন শাস্তি কি আদৌ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে? ২০১৯ সাল শুরু হয়েছিল একই বর্বর ধর্ষনের ঘটনা দিয়ে। নোয়াখালীর সুর্বনচরে নিজের পছন্দের প্রার্থী ও প্রতীকে ভোট দেয়ার অপরাধে ধর্ষনের শিকার হতে হয়েছিল তিন সন্তানের জননীকে ।
এই ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা সবাই ছিল স্হানীয় সরকারদলীয় রাজনৈতিক নেতা কর্মী। এই ঘটনা নিয়ে সাড়া দেশে তোলপাড় শুরু হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ধর্ষকদের গ্রেফতার করতে বাধ্য হয়। পরবর্তীতে ঐ ঘটনার মুল হোতা স্হানীয় আওয়ামীলীগ নেতা রুহুল আমিনের জামিনের ঘটনা নিয়ে ও বেশ নাটকীয়তা দেখেছি।
১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট ঢাকা থেকে দিনাজপুরের দশমাইল এলাকায় নিজ বাড়িতে ফেরার পথে পুলিশ ভ্যানে পুলিশের কয়েকজন সদস্যের দ্বারা গণধর্ষন ও হত্যার শিকার হন চৌদ্দবছরের বালিকা ইয়াসমিন আক্তার। ইয়াসমিন ধর্ষন ও হত্যার ঘটনায় সারাদেশ ফুঁসে উঠেছিল ১৭ জন মানুষকে জীবন পর্যন্ত দিতে হয়েছিল ইয়াসমিন ধর্ষনের প্রতিবাদে অংশনেয়ায়।
যদিও পরে নানান চাপে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের আইনের আওতায় এনে বিচারের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এর পর সকলের ই ধারনা হয়েছিল আমাদের নারীরা দেশে কিছুটা হলে ও নিরাপদে চলতে পারবেন।কিন্তু বস্তবতা হলো তার উল্টো।দিন যাচ্ছে আর আমাদের এই মাটি ক্রমেই অনিরাপদ হয়ে পরছে আমাদের নারীদের জন্য।
১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর টিএসসির সামনে ‘থার্টি ফাস্ট নাইট’ উদযাপনের সময় শাওন আক্তার বাঁধন নামের এক নারীর শ্লীলতাহানি করা হয়েছিলেন ওই ঘটনায় মামলাও হয়েছিল। সেই মামলায় রায় হয় ২০১০ সালে। এতে সব আসামিকেই খালাস দেয়া হয়।তখন ওই ঘটনাটি বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হলে সারাদেশে ব্যাপক আলোড়ন তোলে।
সমালোচনা হয় দেশের বাইরেও। সেই সময় বাঁধনের ঘটনা প্রকাশিত হলেও অপ্রকাশিত থেকে যায় একই দিন আরও ৭ থেকে ৮ জন নারীর শ্লীলতাহানির ঘটনা। কেননা বাঁধন ছাড়া অন্য কেউ মুখ খুলেন নি। বাঁধনের বিষয়টি নিয়ে তখন সংসদেও আলোচনা হয়। ২০১৬ সালের ২০ মার্চ রাতে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় ধর্ষনের পর হত্যা করা হয় কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনুকে।
তনু ধর্ষনের পর হত্যার প্রতিবাদে সারাদেশেই আন্দোলন প্রতিবাদ উত্তাল হয়ে পরে। কিন্তু তনুর ক্ষেত্রে বস্তবতা বড়ই কঠিন হয়ে দাড়ায় খুনি- ধর্ষকরা আজও ধরা ছোয়ার বাইরে রয়ে গেছে। গত বছর কৃত্তিকা পুর্না ত্রিপুরা সহ দুই মারমা বোনের ধর্ষিত হওয়ার ঘটনা কেউই ভুলে যায়নি। নিজ মাদ্রাসার প্রিন্সিপালের যৌনলালসার বিচারের দাবি জানাতে গিয়ে আগুনে পুরে জীবন দিতে হয় নুসরাতকে।
নুসরাতের হত্যার প্রতিবাদে সমগ্র দেশ প্রতিবাদী হলে নুসরাতের খুনিদের আইনের আওতায় এনে বিচারপর সম্মুখীন হতে হয়েছে।এমন ঘটনা আজ বাংলাদেশের প্রতিদিনের চিত্রই না বরং ধর্ষন ও ধর্ষনের পরে খুনের ঘটনা দেশে আজ ভয়াবহ ভাবে বেড়েই চলছে।
বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন আইন সালিশ কেন্দ্রের তথ্য মতে ২০১৮ সালে দেশে মোট ধর্ষণের সংখ্যা ৭৩২টি আর ২০১৯ সালে এই সংখ্যা আটো ভয়াবহ রুপনিয়ে প্রায় দ্বিগুনে দাড়ায় যার সংখ্যা ১৪১৩ টি। কোন অপরাধকেই সংখ্যা দিয়ে নির্নয় করা কোন সভ্যতার মাপকাঠিতে দাড়ায় না তার পর ও একটি চিত্র তুলে ধরতেই এই হিসাব। ঘর থেকে রাজ পথ থানা থেকে গণপরিবহন অফিস থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কোথাও আজ আমাদের নারীরা নিরাপদ নয়।
মানুষ রুপী কিছু শকুনের লোলুপ দৃষ্টি লেগেই আছে আমাদের নারীদের দিকে। ধর্ষণের যন্ত্রনা যে কতটা তীব্রতা তা আমরা কিছুটা বুঝতে পারি যখন দেখি ছোট্ট মেয়ের ধর্ষণের বিচার না পেয়ে বাবা আর মেয়ে মিলে একসঙ্গে ট্রেনের নীচে ঝাপ দিয়ে আত্মাহত্যার পথ বেছে নেন।
তার পর ও আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র আইনের আওতায় এনে ধর্ষকের উপযুক্ত বিচার করতে ব্যর্থ। ধর্ষনের কারন হিসেবে আমাদের অনেকেই নারীর চলাফেরা ও পোশাকে দায়ী করে আসছে।
যা সত্যিকারেই তাদের হীনমন্যতা ছাড়া আর কিছুই নয় নারীর পোষাকই যদি ধর্ষনের কারন হতো তা হলে তনুকে কিংবা আরব বিশ্বের কোন মহিলাকে ধর্ষনের শিকার হয়ে জীবন দিতে হতো পক্ষান্তরে ইউরোপের প্রতিটি নারী ই প্রতি মুহুর্তে ধর্ষনের শিকার হতেন।
একটি রাষ্ট্র বা সমাজে ধর্ষণের মাত্রা বৃদ্ধির মুল কারন ই হলো বিচার ও দায়িত্বহীন সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা। বিচার ও দায়িত্বহীনতার সংস্কৃতিই একটি রাষ্ট্রের সমস্ত অপরাধের মূল কারন।
রাজধানীর কুর্মিটোলার যেই স্হানটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐ শিক্ষার্থী ধর্ষনের শিকার হয়েছেন সেই স্হানটিকে অপরাধ প্রবন এলাকা হিসেবে জেনেই প্রশাসন ঐ স্হানে সাবধানে চলাচলের জন্য সাইনবোর্ড লাগিয়ে রেখেছিলেন। অপরাধপ্রবন এলাকা জেনেও কেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জনস্বার্থে যথাযথ ব্যবস্হা নিতে ব্যর্থ হয়েছেন।
সংবাদমাধ্যম থেকে যতটুকু জেনেছি ঐ এলাকায় সমস্ত অপরাধ ই নাকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাকের ডগার উপর দিয়েই চলে। এর থেকে প্রমান মিলে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন।
আজ আমাদের রাষ্ট্রে বিচারহীনতার সংস্কৃতি জোরদার হওয়াতে অপরাধীরা ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছে। তারা যার যা খুশি তাই করছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা কিংবা সামাজিক প্রতিরোধ কোনোটাই জোরদার হচ্ছে না।
ফলে দেশটা ক্রমেই অপরাধীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হচ্ছে। দেশে সঠিক গণতন্ত্র না থাকায় রাষ্ট্রব্যবস্হায় ক্রমেই ঘুনে ধরছে। সেই সাথে আমরা মানষিক ভাবে এতটাই দুর্বল হয়ে পরেছি যে সামাজিকভাবে অপরাধের প্রতিবাদের ও শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। তাই রাষ্ট্র থেকে ধর্ষনের মহামরি দুর করতে হলে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ভাবে ধর্ষকদের প্রতিহত করতে হবে।
আইনের মাধ্যমে ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে সেই সাথে ধর্ষকে সামাজিক ভাবে প্রতিহত করতে হবে। সর্বগ্রে প্রতিটি মানুষের ভিতর মানবিকতার জন্ম দিয়ে সত্যিকরে মানুষ হতে পারলেই সমাজ তথা রাষ্ট্র থেকে ধর্ষনের মহামরি প্রতিরোধ করা যাবে।
লেখক:ওয়াসিম ফারুক, কলামিস্ট
আরও পড়ুন
সাঈদ খোকনের কান্না ও সিটি নির্বাচন প্রসঙ্গ
মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ ও ভিপি নুর কথন