সাভারের আশুলিয়ায় গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আল আমিন মিয়া মারা গেছেন এমন মিথ্যা দাবি করে মামলা করেন তার স্ত্রী কুলসুম বেগম। মামলা দায়েরের এক মাস পর থানায় এসে হাজির সেই ‘মৃত’ আখ্যা পাওয়া আল আমিন মিয়া। তার ভাষ্য, তার অজান্তেই স্ত্রী অসৎ উদ্দেশ্যে এমন মামলা করেছেন। অবিলম্বে মামলার জটিলতা থেকে রেহাই চান তিনি ও তার পরিবার। এ মামলা নিয়ে আল আমিন ও তার পরিবার চরম মানসিক অশান্তিতে রয়েছেন। তারা এ মামলা প্রত্যারের জন্য এখন থানায় থানায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বৃহস্পতিবার (১৪ নভেম্বর) এ তথ্য নিশ্চিত করে আশুলিয়া থানার পুলিশ পরিদর্শক (ওসি তদন্ত) কামাল হোসেন।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৩০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে আদালতে হাজির হচ্ছেন না বাদী কুলসুম বেগম। এ কারণে আদালত থেকে তাঁর নামে জারি করা সমন সপ্তাহখানেক আগে মানিকগঞ্জের ঘিওর থানায় পৌঁছেছে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।
ভুক্তভোগী আল আমিন মিয়া বলেন, ‘সরকার পতনের দিন ৫ আগস্ট সিলেটে আমার বাসায়ই ছিলাম আমি ও আমার স্ত্রী। তবে আমার স্ত্রী কুলসুম বেগম তিন মাস আগে আমার বাসা থেকে ঝগড়া করে তার বাবার বাড়ি চলে আসে। তারপর থেকে আর তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না। গত তিন/চার দিন আগে আমি জানতে পারি, সে একটা মামলা করেছে যে, আমি গত ৫ আগস্ট মারা গেছি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে।
ওই মামলার এক আসামি আমাকে ফোন করে জানায় বিষয়টি। আমি ওখানে আমার নিকটস্থ সিলেটের দক্ষিণ সুরমা থানায় যাই, সেখানে একটা জিডি করি। সেখানকার ওসি আমাকে আশুলিয়া থানায় পাঠায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি জীবিত আছি। আমার স্ত্রী মিথ্যা মামলা করেছে। আমি মারা যাইনি। আমি এই মামলা প্রত্যাহার করতে চাই।’
পুলিশ জানায়, গত ২৪ অক্টোবর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৩০ জনকে আসামি করে ঢাকা চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন কুলসুম বেগম নামে এক নারী। ওই মামলা গত ৮ নভেম্বর আশুলিয়া থানায় এজাহারভুক্ত হয়। মামলায় কুলসুম বেগম তার স্থায়ী ঠিকানা উল্লেখ করেন মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর উপজেলার স্বল্প সিংজুরি বাংগালা গ্রামে। আর বর্তমান ঠিকানা আশুলিয়ার জামগড়া এলাকায়।
মামলার এজাহারে লেখা হয়, গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে বাদীর স্বামী আল আমিন মিয়া ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নেয়। ওইদিন শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর বিকেল ৪টারদিকে আশুলিয়ার বাইপাইলে বিজয় মিছিলে অংশ নেয় তার স্বামী। তবে পরাজয় মানতে না পেরে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালালে তার স্বামী গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়।
এজাহারে আরও উল্লেখ করা হয়, অনেক খোঁজাখুঁজি করেও বাদী তার স্বামীকে খুঁজে পাননি। এরপর আশুলিয়ার নারী ও শিশু হাসপাতালের ৬ আগস্টের এক প্রতিবেদন থেকে জানতে পারেন, ওই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অজ্ঞাত বিপুলসংখ্যক মৃতদেহ দাফন করেছে। এর কাগজপত্র তার কাছে আছে। এরপর তিনি হাসপাতালের কাগজপত্র, ছবি ও ভিডিও থেকে তার স্বামীর মৃতদেহ শনাক্ত করেন।
এ মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো. আসাদুজ্জামান খান, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, মানিকগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুছ ছালাম, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, সাবেক ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমানসহ ১৩০ জনের নাম উল্লেখ করা হয়।
এদিকে, সম্প্রতি মামলার বিষয়টি জানতে পারে আল আমিন মিয়ার পরিবার। তার পরিবার জানায়, তাদের গ্রামের বাড়ি লালমনিরহাটে। তবে দীর্ঘদিন ধরে পরিবারসহ তারা সিলেটের দক্ষিণ সুরমা থানার পিরিজপুর এলাকায় বাস করছেন। আল আমিন পেশায় মেকানিক। কাজের সূত্রে গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে স্ত্রীসহ মৌলভীবাজারের জুড়ি এলাকায় ছিলেন তিনি। তবে এর কয়েক দিন পরই স্ত্রীর সঙ্গে পারিবারিক কলহ বাধে আল আমিনের। এরপর স্ত্রী তাকে না জানিয়েই মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার সিংজুরিতে তার বাবার বাড়ি চলে আসেন। এরপর থেকে আর যোগাযোগ ছিল না তাদের।
আল আমিন মিয়ার পরিবার জানায়, মামলা হওয়ার প্রায় দুই সপ্তাহ পর তিনি জানতে পারেন, তাকে মৃত দেখিয়ে তার স্ত্রী একটি মামলা করেছেন। মামলায় আসামির নাম বাদ দিতে লোকজনের কাছ থেকে তার স্ত্রী টাকাপয়সা নিচ্ছেন। সেসময় আল আমিন ছিলেন মৌলভীবাজারের জুড়ি এলাকায়। এরপর বিষয়টি খোঁজ খবর নিয়ে আল আমিন প্রথমে জুড়ি থানায় ও পরে দক্ষিণ সুরমা থানায় যান। সেখান থেকে তাকে আশুলিয়া থানায় পাঠানো হয়।
জীবিত আল আমিনকে মৃত দেখানোয় হতবাক তার পরিবার। দ্রæত মামলা বাতিল চান তারা। আল আমিনের বাবা মো. নুরুন নবী বলেন, ‘আমার ছেলে মারা যায়নি। সে জীবিত আছে। মিথ্যা মামলা করেছে তার স্ত্রী। এই মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা হোক।’
তার বড় ভাই জাহাঙ্গীর মিয়া বলেন, ‘আমার ছোট ভাই আল আমিনের স্ত্রী ভুল করে একটা মিথ্যা মামলা করেছে। মামলাটা মিথ্যা বানোয়াট। আমার ভাই বা আমাদের পরিবারের কেউই বিষয়টি নিয়ে অবগত নই। বিষয়টি জানার পর আমরা দক্ষিণ সুরমা থানায় গেছি। তারা আমাদের আশুলিয়া থানায় পাঠিয়েছেন। এই মামলার কারণে যারা ভোগাস্তিতে পড়েছেন, আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত ও ক্ষমা চাই। আমরা জানতাম না এমন মামলা হয়েছে। আমাদের কোনো সম্পৃক্ততা নাই এই মামলার বিষয়ে।’
আশুলিয়া থানার পুলিশ পরিদর্শক (ওসি তদন্ত) কামাল হোসেন বলেন, ‘যেহেতু তিনি মিথ্যা মামলা করেছেন, তাই বাদির বিরুদ্ধে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেবো। আল আমিনকে বিজ্ঞ আদালতে উপস্থাপন করে মিথ্যা মামলার বিষয়ে আইনগত প্রক্রিয়ায় যাব।’