তিনি আসলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন। কথাগুলো শুনতে খুব সহজ মনে হলেও আর্জেন্টিনার অধিনায়ক মেসির জন্যে তা আদতে এতো সহজ ছিল না। টানা ৩৬ বছর মানে তিন যুগের শিরোপার আক্ষেপ ঘুচিয়ে বিশ্বকাপ শুরুর আগে সমর্থকদের দেয়া কথা রাখলেন লিওনেল মেসি।
ফুটবলের এই বরপুত্র নিজেকে তুলে ধরলেন আরও একধাপ উপরে। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সকে হারিয়ে তৃতীয়বারের মতো বিশ্বসেরার মুকুট নিজেদের করে নেয় আলবিসেলেস্তেরা। ফাইনালের শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচে ২-২ গোলে সমতা আসার পরে অতিরিক্ত সময়েও ১-১ গোলে সমতা বিরাজ করে।
এরপর ম্যাচ গড়ায় টাইব্রেকারে। পেনাল্টি শ্যুট আউটে ৪-২ ব্যবধানে জয় তুলে নেয় মেসির আর্জেন্টিনা। এরপরই বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে মাতে সারা বিশ্বের সমর্থকরা। যার ছোঁয়া লেগেছে বাংলাদেশেও।
খোদ রাজধানী ঢাকার বুকে হাজার হাজার ফুটবল ভক্ত মিছিল বের করে। পোড়ানো হয় আতশবাজি। এদিকে ফুটবল বিশ্বের সকল ট্রফিতে নিজের নাম লিখিয়েছেন আর্জেন্টিনার রোজারিও থেকে উঠে আসা ৩৫ বছর বয়সী ফুটবলার মেসি। শুধুই অধরা ছিল সোনালি বিশ্বকাপ শিরোপাটি।
রোববার দিবাগত রাতে কাতারের লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামে শ্বাসরুদ্ধকর লড়াইয়ে টাইব্রেকারে ফ্রান্সকে হারিয়ে তৃতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ জিতে নেয় ম্যারাডোনার পরবর্তী প্রজন্মের ফুটবল তারকারা। বিশ্বকাপ ফাইনাল তো বটেই, ফুটবল ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা ম্যাচের তকমা পেতে পারে এটি।
এ সময় কাতারের লুসাইল স্টেডিয়াম রূপ নেয় আর্জেন্টিনার বুয়েন্স আয়ার্সে। সমর্থকদের কোলাহলে তখন কানে তালা লেগে যাওয়ার জোগাড়। এ চিৎকার যেন আকাশই ছুঁয়ে যায়। এমন উল্লাস হবেই বা না কেন! এই দিনটির জন্য যে আর্জেন্টাইনদের অপেক্ষা ছিল ৩৬ বছরের। ম্যারাডোনার পর মেসি আর্জেন্টিনাকে এই শিরোপা এনে দিলেন।
এবার বিশ্বকাপে গোল্ডেন বুট পেয়েছেন ফ্রান্সের কিলিয়ান এমবাপে। গোল্ডেন বল আর্জেন্টিনার লিওনেল মেসি এবং গোল্ডেন গ্লাভস পেয়েছেন আর্জেন্টিনার গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্টিনেজ।
এদিকে ম্যাচের প্রথমার্ধের পুরোটা জুড়ে ছিল আর্জেন্টিনার প্রতাপ। ৭৭ মিনিট পর্যন্ত ২-০ গোলের লিড ছিল আর্জেন্টিনার। এমবাপে ঝলকে সমতা আনে ফ্রান্স। অতিরিক্ত সময়ে প্রথমার্ধ দুই দল লড়ল সমানে সমান। দ্বিতীয়ার্ধে মেসির গোলে ৩-২ লিড পায় আর্জেন্টিনা। মিনিট তিনেক পরে আবার ফ্রান্সের সমতা।
আবারও পেনাল্টি থেকে গোল করেন এমবাপে। ১৯৬৬ সালে ইংল্যান্ডের জিওফ হার্স্টের পর বিশ্বকাপ ফাইনালের দ্বিতীয় হ্যাটট্রিক করেন এমবাপে। এরপরও ম্যাচের আকর্ষণ বাকি ছিল। আর্জেন্টিনার প্রায় গোল হওয়া বাঁচিয়ে দেন লরিস। অন্যদিকে এমবাপেও আরো গোলের সুযোগ তৈরি করেছিলেন। তবে লাভ হয়নি, ১২০ মিনিটের আগে আর কোনো গোল পায়নি কোনো দল। খেলাটা গড়ায় টাইব্রেকারে।
টাইব্রেকারে এমবাপের গোল দিয়ে শুরু। এরপর মেসিও গোল করেন। আর্জেন্টিনার গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্টিনেজ এরপর কিংসলে কোম্যানের শট সেভ করে দেন। দিবালা গোল করলে আর্জেন্টিনা লিড পায়। ফ্রান্সের তৃতীয় শট মিস হলে বিশ্বকাপ ট্রফির সুবাস পেতে শুরু করে আর্জেন্টিনা। চতুর্থ শটে গোল হলে আর্জেন্টিনার তৃতীয় শিরোপা নিশ্চিত হয়। গতি ও সামর্থ্যে ফ্রান্স আর্জেন্টিনার চেয়ে কম ছিল না৷ তবে ম্যাচের শুরু থেকে নিয়ন্ত্রণ আর্জেন্টিনার অধীনে। বিগত ম্যাচগুলোর মতো এই ম্যাচেও আর্জেন্টিনা পেনাল্টিতে লিড নেয়৷ আর্জেন্টিনা ফরাসি রক্ষণ ভেদে বক্সে প্রবেশ করেছিল।
সেই মুহূর্ত ব্যাক ট্যাকেল। পোলিশ রেফারির পেনাল্টির বাঁশি। মেসি পেনাল্টি থেকে গোল করেন। মেসির গোলের পর পুরো লুসাইল স্টেডিয়াম উল্লাসে ফেটে পড়ে। আর্জেন্টিনা আক্রমণে আরো শাণিত হয়। মেসি তার শেষ বিশ্বকাপের শেষ ম্যাচে দারুণ ঝলক দেখান৷ দ্বিতীয় গোলের ভিত তার দুর্দান্ত পাসে রচিত। ডি মারিয়া প্লেসিংয়ে ব্যবধান যখন দ্বিগুণ করলেন, আর্জেন্টিনা তখন রীতিমতো জয়ের সুবাসই পাওয়া শুরু করে দিয়েছিল।
তবে খেলাটা সেখানেই শেষ হয়ে গেলে রোমাঞ্চটা যেন অপূর্ণই থেকে যেত। তা হয়নি, এরপর গোল হয়েছে, পাল্টা গোল হয়েছে, টাইব্রেকার হয়েছে। রোমাঞ্চের ষোলকলা পূরণ করে তবেই বিশ্বকাপ উঠেছে আর্জেন্টিনার হাতে।