এক শতাব্দীর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্পে লণ্ডভণ্ড তুরস্ক ও সিরিয়া। সোমবার ভোরে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার শক্তিশালী ওই ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত হয়েছে শহরের পর শহর, গ্রামের পর গ্রাম। মুহূর্তেই বালির স্তূপে পরিণত হয়েছে অনেক আধুনিক ভবনও। সোমবার রাত ১১টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত সিরিয়া ও তুরস্কে মৃতের সংখ্যা ২ হাজার ৩০০ জন ছাড়িয়ে গেছে।
প্রতি মিনিটেই বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। এরমধ্যে তুরস্কে ১৫৪১ জন ও সিরিয়ায় ৮১০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এখনও অসংখ্য মানুষ ধসে যাওয়া হাজার হাজার ভবনের নিচে চাপা পড়ে থাকায় মৃতের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এদিকে কয়েক ঘণ্টা পর আঘাত হানা ২য় ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতির তথ্যও আসতে শুরু করেছে। এই ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে লেবানন, ইসরায়েল, ফিলিস্তিন এবং সাইপ্রাসও। অঞ্চলটির অধিকাংশ মানুষই তখন ঘুমিয়ে ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের জিওলজিক্যাল সার্ভে (ইউএসজিএস) জানিয়েছে, স্থানীয় সময় ভোর ৪টা ১৭ মিনিটে শুরু হওয়া ভূমিকম্পটির উৎপত্তি গাজিয়ানতেপ শহরের কাছে ভূপৃষ্ঠের ১৭ দশমিক ৯ কিলোমিটার (১১ মাইল) গভীরে। তারপর থেকে পরবর্তী ঘণ্টাগুলোতে অন্তত ২০টি পরাঘাত অনুভূত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালীটি ৬ দশমিক ৬ মাত্রার ছিল বলে তুরস্কের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। সিরিয়ার পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূলীয় শহর লাতাকিয়া থেকে শুরু করে ভূমিকম্পটি দক্ষিণে রাজধানী দামেস্ক পর্যন্ত অনুভূত হয়েছে।
ভয়াবহ এই ভূমিকম্পে কেবল তুরস্কেই প্রাণহানির সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করছে মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস। সংস্থাটি বলেছে, সোমবার ভোরে দক্ষিণ তুরস্কে আঘাত হানা শক্তিশালী ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে এবং এটি এক লাখে পৌঁছারও কিছুটা আশঙ্কা আছে।
তুরস্ক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে উদ্ধারকারীদের পরস্পরের মধ্যে সমন্বয়ে সহায়তা করতে জনসাধারণকে মোবাইল ফোন ব্যবহার না করার আহ্বান জানিয়েছে। ভূমিকম্পের কারণে স্থানীয় বাসিন্দারা প্রচণ্ড শীতের মধ্যে তুষারে ঢাকা রাস্তায় নেমে আসতে বাধ্য হয়।
তুরস্কের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুলেইমান সোইলু জানিয়েছেন, ভূমিকম্পে গাজিয়ানতেপ, কাহরামানমারাস, হতাই, ওসমানিয়ে, আদিয়ামান, মালাটিয়া, সানলিউরফা, আদানা, দিয়ারবাকির ও কিলিস—এই ১০টি শহর বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
শক্তিশালী এই ভূমিকম্পের পর তুরস্কে জরুরি অবস্থা জারি করেছে দেশটির সরকার। ভূমিকম্প আঘাত হানার পর সকালে দেশটির সরকার ‘লেভেল-৪ সংকেত’ দিয়ে জরুরি অবস্থা জারি করেছে। এর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সহায়তার আহ্বান জানিয়েছে তুরস্ক সরকার। ভূমিকম্পে বহু ভবন ধসে পড়েছে। এসব ভবনে আটকে পড়াদের উদ্ধারে জোর তৎপরতা চালাচ্ছে দেশটির দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা দপ্তর এএফএডি ও পুলিশ সদস্যরা। হতাহতদের অধিকাংশই আলেপ্পো, লাতাকিয়া, হামা ও তারতুস প্রদেশের বাসিন্দা বলে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে।
১৯৩৯ সালের পর তুরস্ক এমন ভয়াবহ ভূকম্পন দেখেনি। এতে ৩ হাজারেরও বেশি ঘর-বাড়ি ধসে পড়েছে। ভূমিকম্পের ফলে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে তুরস্ক এবং সিরিয়া। উদ্ধার হচ্ছে একের পর এক মৃতদেহ। কোনও কোনও পরিবারে সকল সদস্যের মৃত্যু হয়েছে। শোকপালন করবেন বলেও আত্মীয়-পরিজন নেই অনেকের।
এদিকে তুরস্কের ভূমিকম্প দুর্গত এলাকায় আগামী কয়েক দিনে ভারী বৃষ্টি ও তুষারপাতের পূর্বাভাস দিয়েছে বিবিসি। সেখানে দিনের বেলা তাপমাত্রা ৩ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকবে এবং রাতের বেলা তা আরও কমে যেতে পারে বলেও জানানো হয়েছে। এমনকি ওই এলাকায় ৩ থেকে ৫ সেন্টিমিটার গভীর তুষারে ঢেকে যেতে পারে। তুরস্কের উত্তরের পাহাড়ি এলাকায় আরও বেশি তুষারপাতের আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। পাহাড়ে ৫০ থেকে ১০০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত তুষারপাত হতে পারে।
স্বজনদের জীবিত উদ্ধারের আশায় অপেক্ষা: একজন বৃদ্ধা কুর্দি ভাষায় কান্নাকাটি করছেন। তার ভগ্নিপতি, ভাতিজি এবং ভাগ্নেরা ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়েছেন। তাদের জীবিত উদ্ধারের আশায় অপেক্ষার প্রহর গুনছেন তিনি। কিছু অল্পবয়সি প্রতিবেশী তাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছেন। ওই নারীকে সান্ত্বনা দিয়ে তারা বলছেন, কয়েক মিনিট আগে একজনকে উদ্ধার করা হয়েছে। তারা আপনার পরিবারকেও উদ্ধার করবে। তবে ওই নারীর পরিবার ১২ তলা ভবনের নিচতলায় বসবাস করতেন; যে কারণে তাদের জীবিত উদ্ধারের ব্যাপারে খুব একটা আশাবাদী নন তিনি। তিনি বলেন, তারা নিচতলায় ছিল। ঘুমাচ্ছিল। আমি জানি না কেউ তাদের কাছে পৌঁছাতে পারবে কি না... এখানে প্রচণ্ড ঠান্ডা। আমার বাচ্চাগুলো ধ্বংসস্তূপের নিচে জমে যাবে।
তুরস্কে এমন অসংখ্য পরিবারের খোঁজ পাওয়া গেছে, যাদের পরিবারের কোনও সদস্যেরই সন্ধান মিলছে না। এমনকি স্বজন হারানোর শোকে যে কান্না করবেন কিছু পরিবারে এমন একজনও জীবিত নেই। তুরস্কের একটি শহরের উদ্ধার তৎপরতার দৃশ্য তুলে ধরে বিবিসি লিখেছে, উদ্ধারযজ্ঞ চলার সময় আকস্মিকভাবে জনতা উচ্চস্বরে চিৎকার করছেন। তাদের হাততালি দিতেও দেখা যাচ্ছে। উদ্ধারকারীরা ধ্বংসস্তূপের নিচে কারও কাছে পৌঁছানোর সাথে সাথে লোকজন চিৎকার করছেন। তবে যাকে উদ্ধার করা হচ্ছে, তার কোনও আত্মীয় নন এই হাততালি দেয়া লোকজন। তবে কেউ যে উদ্ধার হচ্ছে, তাতেই তারা খুশি। সেখানকার পরিস্থিতিতে বর্ণনায় বিবিসি বলছে, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে নেমে আসছে পিন-পতন নীরবতা। কারণ যাকে উদ্ধার করা হচ্ছে, তিনি মারা গেছেন।
বিবিসির তুরস্ক প্রতিনিধি হাতিস কামের দিয়ারবাকি থেকে বলেছেন, শহরটিতে হিমশীতল ঠান্ডা বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। বৃষ্টিপাতও হচ্ছে। আফটারশকের কারণে কোনও লোকজনই তাদের বাড়ির কাছাকাছি যেতে পারছেন না। যদিও তারা মাঝরাতে বাড়ি থেকে তাড়াহুড়ো করে চলে গেছেন... শীত নিবারণের জন্য জ্যাকেট এবং জুতো নেয়ার জন্য বাড়ি ফিরে যেতে ভয় পাচ্ছেন তারা।