আচমকা সৃষ্টি হওয়া ঘূর্ণিঝড় মিধিলির আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়েছে উপকূলীয় এলাকা। শুক্রবার এ ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে দেয়াল ভেঙে পড়ে ও গাছ চাপায় একই পরিবারের ৪ জনসহ অন্তত ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া পশুর নদীতে ৮০০ টন কয়লা নিয়ে একটি কার্গো জাহাজ ডুবে গেছে। সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে ২০টি ট্রলারসহ ৩০০ জেলে নিখোঁজ হয়েছে। ঝড়ের তাণ্ডবে ভেঙ্গে গেছে বহু গাছপালা ও কাঁচা ঘর-বাড়ী। উপকূলীয় এলাকায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এর প্রভাবে টানা বৃষ্টিপাতে চট্টগ্রাম ও বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন শহরে জলাবদ্ধতা হয়।
এরআগে খেপুপাড়ার কাছ দিয়ে মোংলা-পায়রা উপকূলে আঘাত করে পুরোপুরি স্থলভাবে উঠে আসে ঘূর্ণিঝড় মিধিলি; বৃষ্টি ঝরিয়ে দুর্বল হয়ে পরিণত হয় স্থল নিম্নচাপে।
ঝড়ের বিপদ কমে আসায় মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত নামিয়ে তার বদলে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়। একইভাবে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরসমূহকে ৬ নম্বর বিপদ সংকেত নামিয়ে তার বদলে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলে আবহাওয়া অফিস। ঘণ্টায় ৮৮ কিলোমিটার গতির বাতাসের শক্তি নিয়ে শুক্রবার বেলা ১টার দিকে উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’। পরের দুই ঘণ্টায় বৃষ্টি ঝরাতে ঝরাতে বেলা ৩টার দিকে তা পুরোপুরি স্থলভাগে উঠে আসে।
আবহাওয়াবিদ হাফিজুর রহমান বিকেল ৪টার দিকে বলেন, ঝড়টি দুর্বল হয়ে গভীর নিম্নচাপ আকারে পটুয়াখালী ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে। ওই ঘূর্ণিবায়ুর চক্র স্থলভাগের ওপর দিয়ে আরো উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হবে এবং বৃষ্টি ঝরিয়ে ক্রমান্বয়ে দুর্বল হতে হতে এক পর্যায়ে গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে।
পটুয়াখলীতে বিকাল ৩ টা ৪০ মিনিটে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ১০২ কিলোমিটার উঠেছিল জানিয়ে তিনি বলেন, আপাতত ভয়ের আর কোনো কারণ নাই। তবু আমরা ৩ নম্বর সংকেত দিয়ে রেখেছি কারণ আগামী ২৪ ঘণ্টা বৃষ্টি হবে ও কিছুটা ঝড়ো হাওয়া থাকবে।
ঝড়ের প্রভাবে বৃষ্টিপাতের ফলে কক্সবাজারের টেকনাফ হ্নীলা মৌলভীবাজার এলাকায় মাটির দেয়াল ধসে একই পরিবারের চার জনের মৃত্যু হয়েছে। শুক্রবার ভোরে উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নে এ ঘটনা ঘটে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী। নিহতরা হলেন হ্নীলা ইউনিয়নের মৌলভীবাজারের মরিচ্যাঘোনা এলাকার আনোয়ারা বেগম (৫০), তার ছেলে শাহিদুল মোস্তফা (২০), মেয়ে নিলুফা ইয়াছমিন (১৫) ও সাদিয়া (১১)।
হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী জানান, ভোররাতে ভারী বর্ষণের কারণে হ্নীলার মরিচ্যাঘোনা এলাকায় বসবাসরত মাটির ঘরের দেয়াল ধসে পড়ে। এতে মা-মেয়ে ও ছেলেসহ একই পরিবারের চার জনের মৃত্যু হয়। বিষয়টি প্রশাসনকে জানানো হয়েছে।
এছাড়া মিধিলির প্রভাবে সৃষ্ট বাতাসে চট্টগ্রামে গাছের ডাল ভেঙে এক শিশুসহ দুইজন প্রাণ হারিয়েছে। শুক্রবার সন্দ্বীপ ও মীরসরাই উপজেলায় এ দুই ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন- সন্দ্বীপ উপজেলার মগধরা ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আব্দুল ওয়াহাব (৭২) এবং মীরসরাইয়ের জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের ৪ বছর বয়সী মুনতাহা আরিয়া।
ঘূর্ণিঝড় মিধিলির প্রভাবে দমকা হাওয়ায় টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলায় গাছের ডাল ভেঙে পড়ে এক কাপড় ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়েছে। শুক্রবার দুপুরে উপজেলা পরিষদ গেইটের সামনে এ ঘটনা ঘটে বলে বাসাইলের ইউএনও পাপিয়া আক্তার জানান।
নিহত আব্দুর রাজ্জাক (৪০) উপজেলার মিরিকপুর গ্রামের কুসুম মিয়ার ছেলে। তিনি বাসাইল বাজারের কোটিপতি মার্কেটে কাপড়ের ব্যবসা করতেন।
এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে পটুয়াখালী জেলার আমন ধানে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার সকাল থেকে ঝোড়ো হাওয়া আর মুষলধারে বৃষ্টিতে উপকূলীয় এলাকার অনেক জায়গায় আমন ও ইরি ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। মোংলা বন্দরের পশুর নদীতে কয়লা বোঝাই একটি কার্গো জাহাজ ডুবে গেছে; যেটিতে ৮০০ মেট্রিক টন কয়লা ছিল।
শুক্রবার সকাল পৌনে ৯টার দিকে নদীর ডুবোচরে আটকে তলা ফেটে ‘এমভি প্রিন্স অব ঘষিয়াখালী’ নামে কার্গোটি ডুবে যায় বলে বাংলাদেশ লাইটারেজ শ্রমিক ইউনিয়ন মোংলা শাখার সহ-সভাপতি মাইনুল ইসলাম মিন্টু জানান। তবে জাহাজটি পশুর নদীর পূর্ব পাড়ের চরকানা এলাকার চরের অংশে ডোবায় বন্দরের মূল চ্যানেল পুরোপুরি নিরাপদ রয়েছে। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় মিধিলির কারণে পণ্য ওঠানামার কাজ বন্ধ রেখেছে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ।
ঘূর্ণিঝড় মিধিলির কবলে পড়ে গভীর বঙ্গোপসাগরে ৩০০ জেলেসহ মাছ ধরার ২০টি ট্রলার নিখোঁজ রয়েছে। এতে জেলপল্লিতে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। শুক্রবার বরগুনা জেলা ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি মোস্তফা চৌধুরী এ তথ্য নিশ্চিত করেন।