দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছে। ফলে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামী ১০ থেকে ১৪ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচনে জয়ী সদস্যদের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠিত হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এদিকে নির্বাচন কমিশন দেশের ৩০০টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ২৯৮টির বেসরকারি ফলাফল ঘোষণা করেছে। এসব আসনের মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ২২২টি, জাতীয় পার্টি ১১টি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ এবং বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি একটি করে এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৬২টি আসনে বিজয়ী হয়েছেন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল সোমবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান। নির্বাচন কমিশনের ভিডিও সেন্টারে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্য কমিশনার ও ইসির সচিব উপস্থিত ছিলেন।
জানা যায়, সংসদ সদস্যদের নির্বাচনের বিষয়টি নিশ্চিত করে গেজেট প্রকাশের কাজ শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন। সংবিধান অনুযায়ী, গেজেট প্রকাশের তিন দিনের মধ্যে শপথ পড়াতে হবে। নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের গেজেট প্রকাশের পরপর স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী তাদের শপথ পড়াবেন।
একটি সূত্র জানিয়েছে, নতুন নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ আগামী ১৪ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালি বিজয় অর্জনের পর স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফেরেন। এ কারণে ১০ জানুয়ারি নতুন নির্বাচিত সংসদ সদসদের শপথ গ্রহণ না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
নতুন নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথের বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, এটি আমি বলতে পারবো না। তবে নতুন সরকারের মন্ত্রিসভা আগামী ১৫ জানুয়ারির মধ্যে হয়ে যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
এদিকে শপথ পড়ানোর বিষয়ে সংবিধানে ১৪৮ এর ২ (ক) ১২৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপিত হইবার তারিখ হইতে পরবর্তী তিনদিনের মধ্যে এই সংবিধানের অধীন এতদুদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা তদুদ্দেশ্যে অনুরূপ ব্যক্তি কর্তৃক নির্ধারিত অন্য কোনো ব্যক্তি যে কোনো কারণে নির্বাচিত সদস্যদের শপথ পাঠ পরিচালনা করিতে ব্যর্থ হইলে বা না করিলে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার উহার পরবর্তী তিনদিনের মধ্যে উক্ত শপথ পাঠ পরিচালনা করিবেন, যেন এই সংবিধানের অধীন তিনিই ইহার জন্য নির্দিষ্ট ব্যক্তি’।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট বিরাট ব্যবধানে জয় পায়। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জোটসঙ্গীরা ২৮৮টি আসন পায়। বিপরীতে বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্ট পায় মাত্র সাতটি। বাকি তিনটি আসন পায় অন্যরা। এ নির্বাচনে জয় পাওয়া সংসদ সদস্যদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয় ২০১৯ সালের ৩ জানুয়ারি।
এর আগে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ না করায় আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। এ নির্বাচনের পর ১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও বিপুলসংখ্যক আসন নিয়ে সরকার গঠন করতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ।
রোববার দেশের ২৯৯টি আসনে একযোগে ভোট অনুষ্ঠিত হয়। বেসরকারি ফলাফল অনুযায়ী, এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পেয়েছে ২২২টি আসন। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৬২টি আসনে জয় পেয়েছেন। এছাড়া জাতীয় পার্টি ১১টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) একটি, বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি একটি এবং বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি একটি আসনে জয় পেয়েছে।
এখন এই নির্বাচনের ফলাফল আনুষ্ঠানিকভাবে গেজেট আকারে প্রকাশ করবে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশন গেজেট প্রকাশের পর তিনদিনের মধ্যে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ অনুষ্ঠিত হবে। তবে এবার জাতীয় সংসদে বিরোধীদল কারা হবে, সেটি এখন বেশ আলোচনায় রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেন, অবশ্যই সংবিধান অনুযায়ী যদি দেখা হয় তাহলে তো লাঙ্গল মার্কা হবে। বাকি স্বতন্ত্ররা থাকবেন। তাছাড়া পরিস্থিতি বুঝে বোঝা যাবে সামনের রাজনীতি কোন দিকে যায়। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা কি বিরোধী দল হিসেবে থাকবে? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, সে বিষয়ে তো এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। যতখন পর্যন্ত শপথ না হচ্ছে।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ জয় পেলেও বর্তমান মন্ত্রিপরিষদের তিন সদস্য হেরে গেছেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়ে গঠিত বর্তমান মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও ২৩ জন মন্ত্রী, ১৮ জন প্রতিমন্ত্রী ও তিনজন উপমন্ত্রী রয়েছেন। এই মন্ত্রিপরিষদের তিনজন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি। বাকি সবাই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান। এবারের নির্বাচনে সব থেকে বড় চমক দেখিয়েছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পরিচিত মুখ ও যুবলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। তিনি প্রায় এক লাখ ভোটের ব্যবধানে বর্তমান বেসামরিক বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলীকে পরাজিত করেছেন। হবিগঞ্জ-৪ (মাধবপুর-চুনারুঘাট) আসনে ব্যারিস্টার সুমন এক লাখ ৬৯ হাজার ৯৯ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। বিপরীতে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী নৌকা প্রতীকের মাহবুব আলী পেয়েছেন ৬৯ হাজার ৫৪৩ ভোট।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য’র ভাগ্যেও পরাজয় জুটেছে। যশোর-৫ আসনে নৌকার প্রার্থী হয়ে তিনি ভোট পেয়েছেন ৭২ হাজার ৩৩২টি। বিপরীতে স্বতন্ত্র প্রার্থী ইয়াকুব আলী ঈগল প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে পেয়েছেন ৭৭ হাজার ৪৬৮ ভোট। অর্থাৎ স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্যকে প্রায় ৫ হাজার ভোটে পরাজয় বরণ করতে হয়েছে।