আজ ১০ ডিসেম্বর। গৌরবময় এই দিনে ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীর দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত হয় মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলা। দীর্ঘ ৯ মাসের নির্যাতন, গণহত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাটের অবসান ঘটিয়ে এই দিনেই গজারিয়ায় ওড়ে স্বাধীনতার পতাকা।
১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে এক বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের শীর্ষনেতা ছিলেন আব্দুল খালেক আলো। রাজনৈতিক মতাদর্শ ছিল ভিন্ন, পথও ছিল আলাদা। তবুও ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ শুনতে গিয়েছিলেন তিনি—যে ভাষণ দেশের মানুষের হৃদয়ে স্বাধীনতার আগুন জ্বেলে দিয়েছিল। সেই আগুন ছুঁয়েছিল আলোকেও।
সেই ভাষণ আলোকে শুধু অনুপ্রাণিতই করেনি; শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়েছিল যুদ্ধের ময়দানে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক আলোর বয়স এখন ৮৩। মুক্তিযুদ্ধের সময় যা কিছু ঘটেছিল, যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হয়েছিল, তার সবটা এখন আর তিনি মনে করতে পারেন না। তবে নিজের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ও তার গ্রামের তৎকালীন পরিস্থিতির একটি চিত্রায়ন তুলে ধরতে পারেন। পারেন নিজের দুঃখ ও প্রতিশোধের স্মৃতিচারণ করতে।
জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত এসব স্মৃতিই তার সম্পদ হয়ে থাকবে বলে বিশ্বাস করেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।
অন্ধকার নেমে এলে আলোর সিদ্ধান্ত
২৫ মার্চ ‘অপারেশন সার্চলাইটের’ নৃশংসতা প্রত্যক্ষ করে আলো বুঝে গেলেন—আর অপেক্ষা নয়। ঢাকা ছাড়লেন। ফিরে গেলেন মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া সদরের গোসারচরে (মাথাভাঙ্গা) নিজের গ্রামে। ততদিনে যুদ্ধের দামামা শহর ছেড়ে গ্রাম স্পর্শ করেছে।
স্বাধীনতার জন্য মানুষের শক্তিকে একত্র করতে আলো গড়ে তুললেন ‘আলোর দিশারী’ নামে একটি সংগঠন। স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শুরু হয় প্রশিক্ষণ। যুদ্ধ করতে আগ্রহী এমন যুবক, মাঝবয়সী এমনকি কয়েকজন বয়স্ক ব্যক্তির সমন্বয়ে এই সংগঠনের মাধ্যমে তিনি প্রশিক্ষণ দেন প্রায় ২০০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে।
এই প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধের জন্য মানসিকভাবে উৎসাহ দেওয়া। এ ছাড়া অস্ত্র সম্পর্কেও প্রাথমিক তথ্য শেখানো হয়েছিল। গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত হাবিলদার ওয়ালী উল্লাহ জমাদ্দার ছিলেন তাদের প্রধান প্রশিক্ষক।
সর্বক্ষণ আলোর পাশে ছিলেন তার ছোট ভাই শহীদ মোয়াজ্জেম হোসেন ও বড় ভাই আব্দুর রউফ—যিনি যোদ্ধাদের প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন।
বিশ্বাসঘাতকতা, হামলা এবং ভয়াবহ গণহত্যা
মে মাসের শুরুতে ‘আলোর দিশারী’ স্কুলে প্রশিক্ষণ প্রায় শেষের পথে। ঠিক তখনই ঘটে অঘটন। গজারিয়ার শান্তি কমিটির সদস্য খোকা চৌধুরী এবং স্থানীয় চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহফুজুল্লাহ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে জানিয়ে দেন আলো এবং তার কার্যক্রমের কথা।
স্থানীয়দের এসব ব্যক্তিদের বিশ্বাসঘাতকতায় ১৯৭১ সালের ৯ মে খুব ভোরে পাকিস্তানি বাহিনী হামলা চালায় গজারিয়ায়।
সেদিন সোনালি মার্কেটের সামনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ১১০ জন ছাত্র, কৃষক, মুক্তিযোদ্ধাকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয়। দিনভর হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের পর সন্ধ্যার মধ্যে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৬০। কাফনের কাপড়ের অভাবে কলাপাতা আর পুরোনো কাপড় জড়িয়ে লাশগুলো শোয়ানো হয় ১০টি গণকবরে।
হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন—পাকিস্তানি বাহিনী যেন হিংস্রতায় উন্মাদ হয়ে উঠেছিল। তাদের মূল টার্গেট ছিল আব্দুল খালেক আলো এবং তার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ‘আলোর দিশারী’। রাজাকার কালু মিয়া পথ দেখিয়ে সেনাদের সরাসরি সেখানে নিয়ে যায়।
হামলায় গজারিয়া, নয়ানগর এবং গোসাইরচর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এই এলাকাগুলোর প্রতিটি বাড়িতেই সেদিন অন্তত একজনের মৃত্যু হয়েছিল।
হামলার সময় গ্রামবাসী আলোর কাছে জানতে চেয়েছিল— ‘কোথায় লুকাব?’ পাকিস্তানিরা সাঁতার কাটতে পারবে না বলে তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন নদীর চরে পালিয়ে যেতে। কিন্তু হঠাৎ বিপদের মুখে আলো বুঝতে পারেননি— পাকিস্তানিরা সেদিন স্থলপথের সঙ্গে সঙ্গে স্পিডবোট নিয়েও এসেছিল।
আলো সেদিন চোখের সামনে হারান ছোট ভাই মোয়াজ্জেমকে। হারান পাঁচ চাচাতো ভাই, এক চাচা এবং দূরসম্পর্কের বহু আত্মীয়কে। তিনি নিজেও গুলিবিদ্ধ হন। তীব্র যন্ত্রণা সহ্য করে খালের পানিতে কচুরিপানার আড়ালে বিকেল চারটা পর্যন্ত কাটিয়ে প্রাণে বেঁচে যান।
সেদিনের ভুল বোঝাবুঝি, সন্দেহ ও অবিশ্বাস তার মনে আজও দাগ কেটে আছে। আলো বলেন— ‘সেদিন সবাই শুধু ফলাফল দেখেছিল। সবাই আমাকে সন্দেহ করেছিল। কিন্তু নদীর চরে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শের পেছনে যে যুক্তি ছিল তা কেউ বিবেচনা করেনি।’
এ বিষয়ে আব্দুল খালেক আলো বলেন, ‘একজন নেতা কখন মারা যায় জানেন? যখন তার লোকরাই তাকে এবং তার সামর্থ্য নিয়ে সন্দেহ করে। আমি খুব অসহায় বোধ করতাম কিন্তু তাদের অনুভূতি বুঝতে পারতাম তাই চুপ করে থাকতাম।’
মায়ের প্রেরণা ও প্রতিশোধের শপথ
সব হারানো, সব অপবাদে আলো প্রায় ভেঙে পড়েন— তখন তার পাশে দাঁড়ান মা। মায়ের অটল উচ্চারণ— ‘যুদ্ধে যা। দেশ স্বাধীন করতে হবে। প্রয়োজনে আমিও যুদ্ধে যাব’। মায়ের বাক্যই তাকে আবার ফিরিয়ে দেয় রণাঙ্গনে।
দুইদিন পর হামলায় গুলিবিদ্ধ বড় ভাইকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করিয়ে আলো আবার যুদ্ধে যান। জুনের মাঝামাঝি আবারও আগরতলায় পৌঁছান। মেজর হায়দারের অধীনে সেক্টর ২-এ যোগদানের আগে এবার পান কঠোর প্রশিক্ষণ। গজারিয়ার কমান্ডার নিয়োগ দিয়ে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় নিজগ্রাম গোসাইরচরে। ১৩ আগস্ট গ্রামে ফিরে আসেন—এক নতুন সংকল্প নিয়ে।
আলো বলেন, ‘পাকিস্তানিরা আমাদের গ্রামের অনেক পুরুষ ও আমার আত্মীয়কে হত্যা করে। তারা অন্তত আটজন নারী ও শিশুকে ধর্ষণ করে। এমনকি মসজিদের ভেতরেও।’
১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস। আলো পরিকল্পনা করেন— অতর্কিত হামলার মাধ্যমে তাদের উদযাপন ভণ্ডুল করে দেবেন। সফল হয় সেই পরিকল্পনা।
‘যেহেতু আমাদের গ্রামটি নদী তীরবর্তী ছিল, তাই গেরিলারা পাকিস্তানিদের ওপর ভালোভাবে হামলা করতে পেরেছিল’, বলেন তিনি।
নভেম্বরের শেষ দিকে একটি অপারেশনে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা গ্রেপ্তার করেন শান্তি কমিটির সদস্য খোকা চৌধুরীকে। জনরোষ এতটাই তীব্র ছিল যে তাকে ৮৩ বার ছুরিকাঘাত করা হয়। অন্যান্য রাজাকাররা পালিয়ে যায়, আর আজও তারা পলাতক।
গজারিয়ার মুক্তি, প্রতিশোধ এবং আলোর সম্মান
১৪ আগস্টের পরেও গেরিলা আক্রমণ চলতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা ছোট ছোট গেরিলা দলে ভাগ হয়ে ধারাবাহিকভাবে পাকিস্তানিদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে নাস্তানাবুদ করে তোলেন। পরিস্থিতি অনেকটাই নিজেদের অনুকূলে বুঝতে পেরে ১০ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানিদের ওপর চূড়ান্ত আঘাত হানেন।
মরণপণ যুদ্ধের পর ৬০ জনেরও বেশি পাকিস্তানি সেনা সেদিন মেঘনা নদীর তীরে আত্মসমর্পণ করে। গজারিয়ায় প্রথমবারের মতো জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন আব্দুল খালেক আলো।
‘মুক্ত গজারিয়ায় আমি প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিলাম, আমি দেখলাম শুধু আমার দলের সদস্যরা এবং মুক্তিযোদ্ধারাই নয়, স্থানীয়রাও আমাকে অভ্যর্থনা জানাতে দাঁড়িয়ে আছেন,’ আলো বলেন।
গর্বিত হাসি হেসে এই মুক্তিযোদ্ধা জানান, ‘আমি তখন বুঝতে পারি গজারিয়ার জন্য আমি স্বাধীনতা পেয়েছি, আমার স্বপ্ন পূরণ করেছি এবং আমার সম্মানও ফিরে পেয়েছি।’
ডেস্ক | বাংলাবাজার পত্রিকা.কম


















