কোরবানির ঈদ ঘিরে উৎসবের আমেজ থাকলেও, কোরবানির পশু বাসাবাড়িতে রাখা শহুরে জীবনে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে। গ্রামের বাড়িতে জায়গার অভাব নেই- উঠান, খোলা মাঠ বা খামারবাড়িতে অনায়াসে পশু রাখা যায়। কিন্তু শহরের ফ্ল্যাটভিত্তিক ছোট বাসাবাড়িতে কোরবানির পশু রাখা মানে এক রকম যুদ্ধ।
জায়গার অভাব, নিচতলার ভিন্ন ধর্মাবলম্বী প্রতিবেশীর অসুবিধার চিন্তা, পাহারা দেওয়ার ভাবনা, পশুর ডাক, পরিচ্ছন্নতা রক্ষা, নিরাপত্তা ঝুঁকি ইত্যাদি সবকিছু একত্রে ভাবতে হয়। তবে একটু অগ্রিম পরিকল্পনা করলে এসবও সামলানো সম্ভব। তাহলে চলুন জেনে নেওয়া যাক যে কোন কোন বিষয়ে প্রস্তুতি নিবেন-
১. উপযুক্ত জায়গা
শহরের বাসাবাড়িতে পশু রাখার প্রথম শর্তই হলো উপযুক্ত জায়গা নিশ্চিত করা। সাধারণত বাসার বারান্দা, ছাদ কিংবা বাসার সামনের অল্প খালি জায়গাটা পশু রাখতে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু সব বাসায় এমন জায়গা থাকে না। ছাদের রেলিং যদি মজবুত না হয়, পশু পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। তাই জায়গা যতটুকু আছে, সেটি পরিষ্কার ও নিরাপদ করে তবেই পশু রাখতে হবে। প্রয়োজনে বাঁশ বা কাঠ দিয়ে ঘেরাও তৈরি করে পশুকে সীমিত এলাকায় রাখা যেতে পারে।
২. পরিচ্ছন্নতা
পরিচ্ছন্নতা একটি বড় দিক। পশুর মল-মূত্র পরিষ্কার না করলে দুর্গন্ধ ছড়ায়, মশা-মাছির উপদ্রব বাড়ে এবং প্রতিবেশীদের মধ্যে বিরক্তি সৃষ্টি হয়। প্রতিদিন অন্তত দুইবার ব্লিচিং পাউডার বা জীবাণুনাশক মিশিয়ে পানি দিয়ে পশুর জায়গা ধুয়ে পরিষ্কার রাখতে হবে। নিচতলার বাসিন্দাদের অভিযোগের অন্যতম কারণ হলো, উপরের বারান্দা বা ছাদ থেকে নোংরা পানি পড়া। এজন্য প্লাস্টিকের শিট বা ত্রিপল ব্যবহার করলে ময়লা সহজে পরিস্কার করা যায় এবং পানি নিচে পড়ে না।
৩. পশুর স্বাস্থ্য
পশুর স্বাস্থ্যের দিকেও খেয়াল রাখা জরুরি। গরমে পশু দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়ে, তাই প্রতিদিন পরিষ্কার পানি, খড়, ছোলা ভিজিয়ে বা গমের ভূষি খাওয়ানো উচিত। দিনে অন্তত তিনবার খাবার ও পানি দিতে হবে। পাশাপাশি পশুর শোয়ার জায়গায় শুকনো কাপড়, চট বা খড় বিছিয়ে দিলে আরাম পায় এবং পায়ের সংক্রমণের সম্ভাবনা কমে।
৪. নিরাপত্তা
শহুরে পরিবেশে কোরবানির পশু রাখার সময় একটা বড় ঝুঁকি হলো নিরাপত্তা। অনেক সময় ছুরি বা ধারালো যন্ত্রপাতি পশুর কাছে পড়ে থাকে, যা বিপজ্জনক। শিশুরাও পশুর কাছে খেলতে গেলে দুর্ঘটনার শিকার হতে পারে। তাই পশুকে শক্ত দড়িতে বেঁধে রাখতে হবে, তবে দড়ি যেন গলায় আঁচড় না ফেলে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। ছুরি বা দা পশুর নাগালের বাইরে রাখতে হবে, এবং শিশুদের সাবধান করতে হবে। পাশাপাশি পালাক্রমে রাতের সময় ভাগ করে পাহারা দেওয়া ভালো। বাসার গার্ডকেও পারিশ্রমিকের বিনিময়ে পশুর যত্ন নেওয়ার জন্য বলা যেতে পারে।
৫. সামাজিক দায়িত্ব
এসবের সঙ্গে সামাজিক দায়বদ্ধতাও গুরুত্বপূর্ণ। আপনার রাখা পশু যেন প্রতিবেশীদের জন্য সমস্যা না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। অনেকে রাত্রে পশুর ডাক বা দুর্গন্ধ নিয়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। এসব বিষয় গুরুত্ব দিয়ে দেখা দরকার। পশু আনার পর প্রতিবেশীদের জানিয়ে দেওয়া যেতে পারে, যাতে তারা আগে থেকেই প্রস্তুত থাকেন এবং বিরক্ত না হন।
৬. সিঁড়ি ব্যবহারে সতর্কতা
পশু বাসায় তোলার ক্ষেত্রেও শহরে কিছু বাড়তি সতর্কতা দরকার। অনেক অ্যাপার্টমেন্টে লিফটে পশু তোলার অনুমতি থাকে না। তখন সিঁড়ি ব্যবহার করতে হয়, যা পশুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। বড় গরু উঠাতে হলে মজবুত কাঠ বা র্যাম্পের ব্যবস্থা করতে হয়। কখনো কখনো নিচতলার অতিরিক্ত জায়গা বা গ্যারেজের অংশবিশেষ দালান মালিকের অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করাই সবচেয়ে ভালো হয়।
শহরে কোরবানির পশু রাখা মানে শুধু ধর্মীয় রীতির পালন নয়, এটি পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্যসচেতনতা ও সামাজিক বিবেচনার একসঙ্গে চর্চা। একটু অসতর্কতায় দুর্ঘটনা, অসন্তোষ কিংবা রোগের ঝুঁকি বাড়তে পারে। তাই পশু আনার আগে থেকেই জায়গা প্রস্তুত করা, পরিষ্কারের সামগ্রী জোগাড় করা, খাবারের ব্যবস্থা করা এবং প্রতিবেশীর সুবিধা-অসুবিধ নিয়ে পূর্ব পরিকল্পনা করা উচিত।
একটু যত্ন, কিছু প্রস্তুতি আর সচেতনতার মাধ্যমে শহুরে এই জটিল পরিবেশেও কোরবানির পশু যত্নে রাখা সম্ভব। তাতে উৎসব হয় আনন্দের, পরিবেশ থাকে সুস্থ এবং প্রতিবেশীও স্বস্তিতে থাকেন।