বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন, ২০২৫

১৫ দেশে যাচ্ছে গাজীপুরের কাঁঠাল

১৫ দেশে যাচ্ছে গাজীপুরের কাঁঠাল

গাজীপুরের শ্রীপুরের কাঁঠালকে সম্প্রতি ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্যের স্বীকৃতি দিয়েছে সরকার। স্বাদ ও সুঘ্রাণের বিচারে এ কাঁঠাল শুধু দেশেই নয়, খ্যাতি আছে বিদেশেও। মৌসুম শুরু হতেই শ্রীপুরের বিভিন্ন স্থানে জমে ওঠে কাঁঠালের বাজার। প্রতি বছর রেকর্ড পরিমাণ কাঁঠাল বিক্রি হয়। দেশের বাজার ছাপিয়ে বিক্রি হয় দেশের বাইরেও। জেলা প্রশাসন এ কাঁঠালকে শ্রীপুরের ব্র্যান্ডিং করতে উপজেলা প্রশাসন চত্বরে তৈরি করেছে কাঁঠালের বিশাল ভাস্কর্য। যার অফিসিয়াল স্লোগান ‘সবুজে শ্যামলে শ্রীপুর, মিষ্টি কাঁঠালে ভরপুর’।

ঢাকার অদূরের এ অঞ্চলে প্রতি বছর গড়ে প্রায় আড়াই লাখ মেট্রিক টন কাঁঠাল উৎপাদন হয়। খাজা, গালা ও দুরসা নামক তিন ধরনের কাঁঠাল হয়ে থাকে এ অঞ্চলে। প্রতি বছর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে এসব জাতের কাঁঠাল রপ্তানি করা হয়। শ্রীপুর উপজেলার জৈনা বাজার এলাকায় বসে কাঁঠালের সবচেয়ে বড় হাট। এ ছাড়া শ্রীপুর উপজেলার গাজীপুর ইউনিয়নের নগরহাওলা, মাওনা ইউনিয়নের চকপাড়া, তেলিহাটি ইউনিয়নের টেপিরবাড়ি, রাজাবাড়ি ইউনিয়নের রাজাবাড়ি বাজার, ছাতির বাজার, শ্রীপুর পৌরসভার কেওয়া ও চন্নাপাড়া এলাকায়ও বসে বড়-ছোট হাট। যেসব হাটে দূর-দূরান্ত থেকে আসেন ক্রেতা-দর্শনার্থী। পাইকারি ক্রেতারা এসব হাটে ছুটে আসেন কম দামে সুস্বাদু কাঁঠাল নিতে। সেগুলো নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে বিক্রি করেন ব্যবসায়ীরা। এমনকি রাজধানীর কারওয়ান বাজার, যাত্রাবাড়ী, হেমায়েতপুর ও উত্তরার অনেক পাইকার আসেন এসব হাটে। ট্রাকে ট্রাকে চলে যায় দেশের বিভিন্ন জেলায়।

এ কাঁঠালের চাহিদা বেশি হওয়ায় ছোট (মুচি) অবস্থায়ও বাগান মালিকরা পাইকারদের কাছে গাছ বিক্রি করে দেন। কাঁঠালের এ মৌসুমি ব্যবসাকে কেন্দ্র করে কর্মসংস্থান হয় অন্তত কয়েক হাজার শ্রমিকের। এলাকায় কাঁঠালের প্রাচুর্য থাকায় মৌসুমে খুবই কম দামে বিক্রি হয় কাঁঠাল। নানা সময়ে দেশের বিভিন্ন পণ্য জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও জাতীয় ফলটি জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে এবার।

এলাকাবাসী ও ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার জৈনা বাজারে প্রতিদিন বিক্রি হয় হাজার হাজার কাঁঠাল। দিনে-রাতে প্রায় সব সময়ই কাঁঠালের বেচাকেনা চলে। জমজমাট থাকে ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। দেশের দূর-দূরান্ত থেকে পাইকাররা আসেন। নিয়ে যান রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায়। বাগান থেকে বাজারে আনা, কেনাবেচা, গাড়িতে ওঠা-নামাসহ নানা কাজ করে শত শত লোক। জৈনা বাজারের আশপাশে অনেক কাঁঠাল বাগান আছে। ভালো যোগাযোগব্যবস্থা এবং পাইকারদের থাকা-খাওয়ার অবকাঠামোগত সুবিধার কারণে জৈনা বাজার হয়ে উঠেছে কাঁঠালের সবচেয়ে বড় বাজার।

শ্রীপুরের জৈনা বাজার, সিডস্টোর, মাওনা চৌরাস্তা বাজার, বাঘের বাজার, বানিয়ারচালা ও ভবানীপুর বাজারে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ঘেঁষে বড় বড় কাঁঠালের বাজার বসছে। জ্যৈষ্ঠের শুরুতে এরকম চিত্র চলে আষাঢ় মাসের শেষ পর্যন্ত। শ্রীপুরের বাগান মালিকেরা এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন। গাছ থেকে কাঁঠাল সংগ্রহ করে বাজারজাত করার জন্য বাগান মালিকদের পাশাপাশি বাড়ির নারীরাও সহযোগিতা করছেন। বাগান মালিকেরা প্রতিদিন ভোরে বাগান থেকে পাকা কাঁঠাল সংগ্রহ করে বিক্রির জন্য ভ্যান, ঠেলাগাড়িতে করে নিয়ে আসছেন বাজারে। বর্তমানে এ অঞ্চলে চলছে কাঁঠালের ভরা মৌসুম। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলেই দেখা যায় মহাসড়কের ওপর ট্রাকের বহর। লাইন ধরে বিভিন্ন আড়তের সামনে থেকে ট্রাকে কাঁঠাল উঠছে।

গাজীপুরের গ্রামগুলো এখন কাঁঠালে সয়লাব। যেদিকে চোখ যায় শুধু কাঁঠাল আর কাঁঠাল। বাড়ির উঠান, ঘরের বারান্দা সবখানে একই দৃশ্য। হাট-বাজারে বিক্রিও হচ্ছে দেদার। শুধু তাই-ই নয়, এ কাঁঠাল চলে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যসহ ১৫টি দেশে। বাণিজ্যিকভাবে রপ্তানি হচ্ছে গাজীপুরের কাঁঠাল।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে কাঁঠালের রাজধানীখ্যাত গাজীপুরের কাপাসিয়া ও শ্রীপুরে এবারও বাম্পার ফলন হয়েছে। সহজ যোগাযোগব্যবস্থার ফলে রাজধানী ঢাকা ও দেশের অন্যান্য এলাকা থেকে ব্যবসায়ীরা প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে চাষিদের কাছ থেকে গাছ বা বাগান থেকে কাঁঠাল কিনছেন।

বিদেশে কাঁঠাল রপ্তানি সম্পর্কে গড়গড়িয়া মাস্টারবাড়ি বাজারের কামাল হোসেন জানান, শ্রীপুরের কাঁঠাল পৃথিবীর বহু দেশে রপ্তানি হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যসহ ১৫টি দেশে যাচ্ছে নিয়মিত। তবে তার অভিযোগ, শ্রীপুরে কাঁঠাল সংরক্ষণের জন্য কোনো হিমাগার গড়ে ওঠেনি। শুধু সংরক্ষণের অভাবে প্রতি মৌসুমে লাখ লাখ টাকার কাঁঠাল নষ্ট হয়।

মৌসুম শুরু হলে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশের কাঁঠালপ্রেমী ও ব্যবসায়ীরা ছুটে আসেন এ গ্রামে। তাদের মাধ্যমে প্রতিদিন ট্রাক, পিকআপ ভরে বিমানবন্দর হয়ে বিভিন্ন দেশে চলে যায় কাঁঠাল।

কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, কাঁঠাল চাষের জন্য যে মাটি ও আবহাওয়া প্রয়োজন; তার সবই কাপাসিয়া ও শ্রীপুরের সব ইউনিয়নে বিদ্যমান। ফলে চাষিরা কাঁঠালকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে উঁচু জমিতে প্রতি বছরই নতুন নতুন বাগান সৃষ্টি করছেন। এলাকা বন্যামুক্ত হওয়ায় কাঁঠাল চাষ করা সহজ। প্রতি বছর বৈশাখ মাসে উপজেলার কৃষকেরা ইরি-বোরো ধান কাটা আরম্ভ করেন। ধান কাটা শেষ না হতেই কাঁঠাল বিক্রির মৌসুম শুরু হয়।

স্থানীয়রা জানান, কাপাসিয়া উপজেলার ১১টি ইউনিয়নের ৩২টি হাট-বাজারে মৌসুমি ফল বিক্রির জন্য আলাদা বাজার বা স্থান না থাকায় কৃষকদের সমস্যা হচ্ছে। হয়রানিরও শিকার হতে হয়। খোদ কাপাসিয়া সদর বাজারে বসে উপজেলার সবচেয়ে বড় বাজার। অথচ এখানে আলাদা কোনো ব্যবস্থা নেই। এ সমস্যার ফলে কৃষকেরা তাদের কাঁঠাল বাজারে নিয়ে বিক্রি করতে পারছেন না। ফলে প্রকৃত মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ফড়িয়ারা বাজার মূল্যের চেয়ে কম মূল্য দিচ্ছেন। কৃষকেরাও বাধ্য হচ্ছেন অপেক্ষাকৃত কম দামে বিক্রি করতে।

কাঁঠাল চাষিরা জানান, উপজেলার অন্যতম অর্থকরী ফসল এ কাঁঠাল। অথচ কাঁঠাল চাষের ব্যাপারে নেই কোনো সরকারি উদ্যোগ। নেই কোনো ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা। সরকারিভাবে যদি কাঁঠাল চাষ বৃদ্ধির ওপর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকতো, তাহলে আরও বেশি ফলন পাওয়া যেত।

গাজীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গাজীপুর সদর উপজেলায় ২০৫০ হেক্টর, কাপাসিয়ায় ১৭৬০ হেক্টর, শ্রীপুরে ৩৫৫২ হেক্টর, কালিয়াকৈরে ৫৫০ হেক্টর ও কালীগঞ্জে ১১৯১ হেক্টর জমিতে কাঁঠালের আবাদ হয়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর গাজীপুরের উপ-পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম খান বলেন, ‘২০২৩-২৪ অর্থবছরে গাজীপুরে মোট ৯ হাজার ১০৩ হেক্টর জমিতে কাঁঠালের আবাদ হয়। এতে ২ লাখ ৪৯ হাজার ৭৯২ মেট্রিক টন কাঁঠাল উৎপাদন হয়েছে। কাঁঠাল চাষিদের প্রশিক্ষণ, বাজারজাতকরণ, গুণগতমান রক্ষাসহ নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে।’


সম্পাদক : অপূর্ব আহমেদ