চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ৮ ডিসেম্বর সৌদি আরব সফর করেছেন। রিয়াদ ও এর মিত্র ওয়াশিংটনের মধ্যে সাম্প্রতিক উত্তেজনার মধ্যে এশিয়ার শক্তিধর এই দেশ মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে প্রবেশের পথ খুঁজছে।
রুশ বার্তা সংস্থা আরটির প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রের বদলে সৌদি আরব কেন চীনের দিকে ঝুঁকছে, তার কারণ বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
ওই প্রতিবেদন বলছে, অন্য দেশে নাক না গলানোর নীতিতে চলে চীন। ওয়াশিংটন উপসাগরীয় দেশ ও ইরানে সহিংসতা জিইয়ে রাখতে শিয়া ও সুন্নিগোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধে উসকানি দিয়েছে। তবে বেইজিং দুই পক্ষের মধ্যেই ফলপ্রসূ অর্থনৈতিক সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে।
চীন এ বছরের শুরুতে সৌদি আরবের আঞ্চলিক প্রতিপক্ষ ইরানের সঙ্গে ২৫ বছর মেয়াদি চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। এই চুক্তিতে বাণিজ্য, অর্থনীতি, পরিবহনসহ অনেক বিষয়ে অংশীদারিত্ব থাকবে।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, মধ্যপ্রাচ্যে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা অর্জনে চীন এ বছরের শুরুতে পাঁচ দফা নিরাপত্তা কর্মসূচি উপস্থাপন করেছে।
এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে—পারস্পরিক সমঝোতায় সমর্থন, সমতা ও ন্যায়বিচার সমুন্নত রাখা, পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ কর্মসূচিতে সাফল্য অর্জন, যৌথভাবে সমষ্টিগত নিরাপত্তা বৃদ্ধি, উন্নয়ন সহযোগিতা ত্বরান্বিত করা।
চীনের এই পাঁচ দফা কর্মসূচিকে এ অঞ্চলের দেশগুলো স্বাগত জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো ইরাকে হামলার পথে না গিয়ে চীন কীভাবে ইরানের সঙ্গে নিরাপত্তা সহযোগিতা জোরদার করার পথ বেছে নিয়েছে, পাঁচ দফা কর্মসূচিকে তার একটি উদাহরণ বলে মনে করা হচ্ছে।
তবে কূটনৈতিক যত দিকই বিশ্লেষণ করা হোক না কেন, সি চিন পিং তার সফরে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ইস্যুকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি সামলাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন উৎপাদন বাড়াতে আহ্বান জানান। তবে বাইডেনের এই আহ্বান সত্ত্বেও গত অক্টোবরে ওপেকের বৈঠকে সৌদি আরব তেলের উৎপাদন কমানোর পক্ষে ভোট দেয়।
এতে ক্ষুব্ধ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এই টানাপড়েনের মধ্যেই রিয়াদ সম্পর্ক উন্নয়নে পাশ্চাত্য থেকে প্রাচ্যের দিকে ঘুরেছে।
চীন বেইজিং-নেতৃত্বাধীন বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) স্বাক্ষরকারী দেশ। এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকাকে সংযুক্ত করার মূল কেন্দ্র হিসেবে চীন বিবেচিত হচ্ছে।
সৌদি আরব চীনের সঙ্গে উন্নয়ন সহযোগিতা বাড়াতে চায় এবং এ থেকে সুফল পেতে চায়। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোর সঙ্গে বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদারে আগ্রহী চীন।
একই সময়ে সহযোগিতা জোরদারে দুই পক্ষের মধ্যে কিছু শর্তও রয়েছে। আরব দেশগুলোর মধ্যে রিয়াদ চীনের শক্তিশালী বাণিজ্যিক অংশীদার। ২০১৩ সাল থেকে চীন সৌদি আরবের বড় বাণিজ্যিক এলাকা।
বিশেষ করে চীন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে কাঁচামালের বড় আমদানিকারক। অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য চীন এসব কাঁচামাল ব্যবহার করে।
এর মধ্যে সৌদি তেলও রয়েছে। ‘ভিশন ২০৩০’ এ সবুজ উন্নয়ন উদ্যোগ নিয়েও বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছে সৌদি আরব।
গণমাধ্যমের খবর অনুসারে সির সফরকালে চীন ও সৌদি আরবের মধ্যে ২ হাজার ৯০০ কোটি ডলারের চুক্তি হবে।
সৌদি আরবের সঙ্গে চীনের মিত্রতার ক্ষেত্রে বড় যে বিষয়টি ভূমিকা রেখেছে, তা হলো বেইজিং কেবল অর্থনৈতিক সম্পর্কের দিকটিতেই গুরুত্ব দেয়।
মিত্রদের ওপর রাজনৈতিক কোনো চাপ প্রয়োগ করে না। যেমনটা যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা ও অন্যান্য উপায়ে রাশিয়ার সঙ্গে বিরোধে জড়াতে সৌদি আরবের ওপর চাপ প্রয়োগ করেছে
মধ্যপ্রাচ্য থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো চীনের কোনো দেশে হস্তক্ষেপ বা নাক না গলানোর নীতি।
ওয়াশিংটনের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে সহিংসতা বেড়েছে। অনেক দেশ ধ্বংস হয়েছে। সহিংসতার কারণে অনেকে উদ্বাস্তু হয়েছে। তবে বেইজিং অন্য উপায়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে।
একতরফা রাজনৈতিক লেনদেন বা বিশেষ জাতিগত বিদ্বেষ নয়, বেইজিং সাধারণ স্বার্থের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়।
মধ্যপ্রাচ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ওয়াশিংটনের তুলনায় চীনের সাফল্য রয়েছে। চীনের সাফল্য হলো দেশটি সৌদি আরব ও ইরানের মতো দেশগুলোর সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারিত্ব বজায় রাখতে পারে। পশ্চিমা দেশগুলো এমনটা কখনোই করতে পারেনি। বরং পশ্চিমারা বিরোধ জিইয়ে রেখে নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার চেষ্টা করেছে।