বুধবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০২৫
সংবাদ শিরোনাম
বাংলাবাজার পত্রিকা.কম যে ১১ পেশায় যুক্ত হতে পারবেন না এমপিও শিক্ষকরা বাংলাবাজার পত্রিকা.কম প্রবাসী ভোটার নিবন্ধন ছাড়াল ৪ লাখ ৫৬ হাজার বাংলাবাজার পত্রিকা.কম বিজয় দিবসে ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্পে রাজাকারের পাঠ’ নাটকে জামায়াত নেতাদের বাধা বাংলাবাজার পত্রিকা.কম বিদেশে শ্রমশক্তি রপ্তানিতে বড় বাধা দালাল চক্র: প্রধান উপদেষ্টা বাংলাবাজার পত্রিকা.কম অস্ট্রেলিয়ার ঘটনাকে ‘চরম ইসলামপন্থী সন্ত্রাসী হামলা’ আখ্যা তুলসী গ্যাবার্ডের বাংলাবাজার পত্রিকা.কম হঠাৎ ঢাকার ভারতীয় ভিসা সেন্টার বন্ধ ঘোষণা বাংলাবাজার পত্রিকা.কম শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ঘোষণা, তেজগাঁও কলেজের সামনে পুলিশ মোতায়েন বাংলাবাজার পত্রিকা.কম সোহেল রানা-হুমায়ূন ফরীদি-জসীমসহ যারা মুক্তিযুদ্ধে জীবন বাজি রেখেছিলেন বাংলাবাজার পত্রিকা.কম স্নাতক পাসে নিয়োগ দেবে প্রাইম ব্যাংক, থাকছে না বয়সসীমা বাংলাবাজার পত্রিকা.কম কম পরিশ্রমে ওজন কমানোর কার্যকরী উপায়

বেপরোয়া সিন্ডিকেটে ভোক্তারা অসহায়

বেপরোয়া সিন্ডিকেটে ভোক্তারা অসহায়

সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না দ্রব্যমূল্য। বেশ কিছু জরুরি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিলেও পাইকারি খোলাবাজার এমনকি সুপার শপেও প্রকাশ্যেই বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে এসব পণ্য। নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্তকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এখনো সক্রিয় রয়েছে অসাধু সিন্ডিকেট চক্র। তারা রীতিমতো পকেট কাটছে ভোক্তাদের। গুটিকয়েক অসাধু সিন্ডিকেটের কাছে যেন অসহায় কোটি ভোক্তা। অসাধু সিন্ডিকেটের দৌরাত্মের কথা স্বীকার করছেন মন্ত্রী-আমলারাও।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্ষমতাসীনদের সহযোগিতা ছাড়া এই অসাধু সিন্ডিকেট টিকে থাকতে পারে না। সিন্ডিকেট যত শক্তিশালীই হোক না কেন তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা না নিলে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে।

দফায় দফা দাম বেড়ে যাওয়ায় গত ১৪ সেপ্টেম্বর জরুরি তিনটি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেয় সরকার।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের সুপারিশের আলোকে আলুর সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৩৫-৩৬ টাকা, দেশি পেঁয়াজের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৬৪-৬৫ টাকা আর ডিমের পিস সর্বোচ্চ ১২ টাকা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। দাম নির্ধারণ করে দেয়ার ১৫ দিন পার হলেও বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে জরুরি এসব পণ্য। উল্টো বেড়েছে পেঁয়াজের দাম। বেড়েছে মরিচের দামও। প্রতি কেজি কাঁচা মরিচ বিক্রি হচ্ছে ২৩০ থেকে ২৫০ টাকা।

রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৪৫-৫০ টাকা। ফুটপাত কিংবা ভ্যানগাড়িতে কিছু নিম্নমানের আলু পাওয়া যাচ্ছে ৪০ টাকায়। যখন আলুর দাম ২৫-৩০ টাকা কেজি ছিল তখন এসব নিম্নমানের আলু ১৫-১৮ টাকা দিয়েও কিনত না ক্রেতারা। এক সপ্তাহ আগেও দেশি পেঁয়াজ ৮৫-৯০ টাকা বিক্রি হলেও শুক্রবার তা বিক্রি হতে দেখা যায় ৯০-৯৫ টাকায়। কিছু নিম্নমানের পচন ধরা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৬৫-৭০ টাকায়। বাধ্য হয়ে এসব পেঁয়াজেই বেশি ঝুঁকছেন সাধারণ ক্রেতারা। ডিমের দাম প্রতি পিস ১২ টাকা বা প্রতি ডজন ১৪৪ নির্ধারণ করা হলেও খুচরা বাজারে প্রতি ডজন ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আবার বিভিন্ন মুদির দোকানে ডিমি বিক্রি হচ্ছে ১৫৫ টাকা ডজন। দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার পরপরই সুপার শপগুলোতে আলু-পেঁয়াজ না থাকার খবর পাওয়া গেছে। কোনো কোনো এলাকার সুপার শপে পাওয়া গেলেও বিক্রি হচ্ছে বাড়তি দামেই।

জানা গেছে, বর্তমানের হিমাগারগুলোতে যা আলু আছে বেশিরভাগই ব্যবসায়ীদের। ফেব্রুয়ারি-মার্চের দিকে চাষিরা জমি থেকে বিক্রি করেছেন ১০-১৫ টাকা কেজি। যা প্রতি কেজি উৎপাদন করতে কৃষকের খরচ পড়ে ৮-৯ টাকা। কৃষক শুধু বীজের জন্য সামান্য আলু হিমাগারে রাখেন। গত মার্চে ব্যবসায়ীরা ৫০ কেজির বস্তায় ভরে আলু হিমাগারে রেখেছেন। বস্তা খরচ, হিমাগার ভাড়া, শ্রমিকসহ পরিবহন খরচ সব মিলিয়ে ব্যবসায়ীদের খরচ হয়েছে ২২-২৩ টাকার মতো। সেই আলু পাইকারিতে বিক্রি করছেন ৩৫-৪৫ টাকা পর্যন্ত।

সমপ্রতি বেশ কয়েক জায়গায় হিমাগারে অভিযান চালিয়ে ৩৭-৩৮ টাকায় আলু বিক্রি করার সময় হাতেনাতে ধরে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। করা হয় জরিমানা।

উত্তরের জেলা দিনাজপুরের প্রান্তিক কৃষক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘কয়েক বছর ধরেই লসে আলু বিক্রি করি। ৮-১০ টাকাতেও কেউ কিনছিল না তখন। এই বছর ১২-১৪ টাকা কেজি আলু বিক্রি করেছিলাম। এখন সেই আলুর দাম ৫০ টাকা। কয়েক মাস খাটা-খাটনি, পরিশ্রম করে আমরা আলু আবাদ করি। পানির দামে বেচে দেই। আর ব্যবসায়ীরা কোনো শ্রম না দিয়ে কয়েকগুণ লাভ করতেছে। এই দুঃখ কারে কই।’

একই অবস্থা পেঁয়াজ চাষিদেরও। কঠোর পরিশ্রম করে ফসল ফলিয়ে মৌসুমের সময় পেঁয়াজ ১৫-২০ টাকা বিক্রি করে কৃষক। যখন পেঁয়াজ চলে গেছে সব ব্যবসায়ীদের কাছে তখন তার দাম ৮০-৯০ টাকা।

এছাড়া বাজারে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ রয়েছে। প্রতি বছরই চাহিদার চেয়ে বেশি উৎপাদন হয় পেঁয়াজ। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ২৫ লাখ মেট্রিক টন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের দাবি, এ বছর দেশীয় উৎপাদন ছিল প্রায় ৩৪ লাখ মেট্রিক টন।

বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় এসব পণ্য কিনতে এলে হতাশ হতে হয় সাধারণ ভোক্তাদের। অসাধু সিন্ডিকেট চক্রের কবলে যখন ২০-৩০ টাকার পণ্য দ্বিগুণ দামে কিনতে হয় তখন কেবল অসহায়ত্ব ফুটে উঠে তাদের চোখে-মুখে। রাজধানীর মুগদা মদীনাবাগ বাজারে আলু কিনতে আসা শেখ ফরিদ বলেন, ‘এই আলু তো বাইরে থেকে আসে না। সিজনের সময় কৃষক আলুর দাম পায় না। অহন এত দামে কিনতে হচ্ছে কেন? নাকি আলুও রাশিয়া-ইউক্রেন থেইকা ডলার দিয়া কেনা লাগে। আমাদের সাধারণ মানুষের জন্য কেউ নাই।’

আরেক ক্রেতা বলেন, ‘আইজকা আলুর দাম বাড়ে, কাইলকা পেঁয়াজ, পরশু মরিচ, একটার পর একটা লাইগা আছে। সবখানেই নাকি সিন্ডিকেট। এসব সিন্ডিকেট করে কারা। নেতা-খেতারাই তো করে। আমরা কি বুঝি না।’

নিত্যপণ্যের বাজারে সিন্ডিকেটের কথা স্বীকার করছেন খোদ মন্ত্রী-আমলারাও। গত বুধবার আলুর দাম প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘গত বছর দাম কম পাওয়ায় এ বছর আলুর উৎপাদন কিছুটা কম হয়েছে। তাছাড়া আমরা কিছু আলু রফতানি করেছি। তারপরও আলুর দাম এতটা বেশি হওয়া উচিত নয়। এটা হয়েছে সিন্ডিকেটের কারণে। আমরা সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি।’

বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন বলেন, ‘আলু ও পটলের দাম নিশ্চয়ই বিদেশ থেকে ঠিক করা হয় না। এটা আমাদের দেশেই হয়। আমাদের লজ্জা লাগে, যখন কালোবাজারিরা বলে, দাম নিয়ে আমরা কী করব? সরকার তাদের কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। জনগণের যদি অংশগ্রহণ না থাকে, সমাজের যদি সহযোগিতা না থাকে, তাহলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা কারও পক্ষে একা সম্ভব হবে না। কালোবাজারিরা পাগলা ঘোড়ার মতো চলতেই থাকবে। তাদের মধ্যে কোনো মনুষ্যত্ববোধ কাজ করে না।’সিন্ডিকেট নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তোপের মুখে পড়তে হয় বাণিজ্যমন্ত্রীকেও।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু দাম বেঁধে দিলেই কিংবা কিছু অভিযান জরিমানা করলেই হবে না। মূল জায়গায় তদারকি করতে হবে। সিন্ডিকেট যত শক্তিশালীই হোক তা ভেঙে দিতে হবে। তা না হলে সামনে বিপদ আরও বাড়বে। এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমাদের মূল জায়গায় হাত দিতে হবে। আপনার যদি জ্বর হয়, ডাক্তার আপনাকে হয়ত প্যারাসিটামল দিল। এতে আপনার জ্বর হয়ত সাময়িকভাবে কমতে পারে। কিন্তু জ্বরতো বড় কোনো রোগের উপসর্গ। এখন যদি মূল রোগের টিটমেন্ট না দিয়ে শুধু জ্বরের চিকিৎসা করা হয়, তবে অবস্থা এমন হওয়াটা স্বাভাবিক। এখন যে কারণে দ্রব্যমূল্য বাড়ছে মূল জায়গায় ধরা হচ্ছে না। আমাদের দেশে তো যথেষ্ট উৎপাদন হয়। সিন্ডিকেট-চাঁদাবাজির কারণে যে দাম বাড়ছে সেই সমস্যার সমাধান করতে হবে। সেসব জায়গায় হাত না দিয়ে যদি একটা দাম বেঁধে দেন তাহলে তো আর সমস্যা সমাধান হবে না। সরকার বা সরকারি দলের কোনো পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলে আমাদের মতো সরকারব্যবস্থায় কোনো ধরনের অন্যায় হতে পারে না।’

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘সরকার তো সব কিছু বিবেচনা করে হিসাব-নিকাশ করেই এসব পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। এখন নির্ধারিত দামে বিক্রি করলে স্বাভাবিক মুনাফা হচ্ছে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা তো স্বাভাবিক লাভে আগ্রহী না। বেশি লাভ করতে চায়। এখন ব্যবসায়ীদের এই প্রবণতা যদি বন্ধ না হয়, তবে যেখানে থেকে উৎপাদন হয় অথবা যেখান থেকে পণ্য ছাড় হয় সেখানে মূল্যটা প্রথম ঠিক করতে হবে। সাপ্লাই চেইন যদি ঠিক রাখা যায়, তবে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে একটু তত্ত্বাবধান করলেই বাজার ঠিক হয়ে যাবে। কড়াভাবে বলছে, শুধু বললেই হবে না। কড়াভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। সিন্ডিকেট যতই শক্তিশালী হোক না কেন তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।’

সূত্র: ঢাকা মেইল 

সম্পাদক : অপূর্ব আহমেদ