বুধবার, ১২ মার্চ, ২০২৫

৪০০ বছরের ঐতিহ্যের সাক্ষী বড় শরীফপুর মসজিদ

৪০০ বছরের ঐতিহ্যের সাক্ষী বড় শরীফপুর মসজিদ

কালের সাক্ষী হয়ে আছে তিন গম্বুজবিশিষ্ট ঐতিহাসিক বড় শরীফপুর মসজিদ। মনোহরগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক মসজিদ। এটি বাংলাদেশে অবস্থিত মুঘল স্থাপনার মসজিদ। উপজেলার বাইশগাঁও ইউনিয়নের বর শরীফপুর গ্রামের প্রায় ৪০০ বছর পুরোনো মসজিদটি ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। এখনো আগের মতোই দেখতে। পৌনে চারশ বছরেও এটির সৌন্দর্য নষ্ট হয়নি। প্রতিদিন তিন উপজেলার বাসিন্দারা এখানে এসে নামাজ আদায় করেন। এর পাশাপাশি মসজিদের পেছনে আছে ‘নাটেশ্বর দীঘি’। সেটির পাড়ে বসলে স্নিগ্ধ হাওয়ায় ঝরে যাবে দেহের যত ক্লান্তি।


জানা যায়, বড় শরীফপুর মসজিদের বাইরের দৈর্ঘ্য ১৪ দশমিক ৪৮ মিটার ও  প্রস্থ ৫ দশমিক ৯৪ মিটার। মসজিদের ওপরে তিনটি গম্বুজ রয়েছে। গম্বুজে রয়েছে পদ্মফুলের নকশা। মসজিদের সামনের দেওয়ালে ফার্সি ভাষায় শিলালিপি লেখাটি ঠিকমতো বুঝতে না পরলেও স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, শরীফপুর এই গ্রামে ১৬২০-১৬২৫ সালে মসজিদটি নির্মাণ করেন জনৈক হায়াতে আবদুল করিম। প্রচলিত মতানুযায়ী নির্মাতা অত্র এলাকার কোতোয়াল ছিলেন। তাই এটি কোতোয়ালি মসজিদ নামে পরিচিত। হায়াতে আবদুল করিমের পরিচয় নিয়ে দুটি মত রয়েছে, একটি হচ্ছে তিনি নাটেশ্বর নামের এক রাজার কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি সৈয়দ শাহ শরীফ বাগদাদি নামে একজন দরবেশের মুরিদ ছিলেন। ১৯৫৯ সাল থেকে মসজিদটি সংরক্ষিত স্থাপনা হিসেবে সংরক্ষিত রয়েছে। ১৯৬০-এর দশকে মসজিদটি সংস্কার করা হয়। পরবর্তীতে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর আরও সংস্কারকার্য চালায়।


মসজিদটির আকৃতি আয়তাকার


মসজিদের পূর্বদিকের অংশে তিনটি খিলানযুক্ত দরজা রয়েছে; যার মধ্যে কেন্দ্রীয় দরজাটি অপেক্ষাকৃত বড়। দরজাগুলোর বিপরীত দিকে পশ্চিম দেওয়ালে তিনটি মিহরাব রয়েছে। এক্ষেত্রেও কেন্দ্রীয় মিহরাবটি বাকি দুইটি মিহরাবের তুলনায় অপেক্ষাকৃত বড়। মসজিদের চারকোণে চারটি বড় অষ্টভুজাকার মিনার রয়েছে। এছাড়াও কেন্দ্রীয় বৃহৎ প্রবেশপথের ওপরে দুইটি অষ্টভুজাকার মিনার রয়েছে। গম্বুজের সংখ্যা তিনটি। কেন্দ্রীয় গম্বুজটি অপেক্ষাকৃত বৃহৎ। গম্বুজের ভেতরের অংশ পাতার নকশা শোভিত। এছাড়া বাইরের অংশে চক্রনকশার কাজ রয়েছে।


শরীফপুর মসজিদটির সীমানা


মনোহরগঞ্জ উপজেলায় পড়লেও মূলত ঐতিহাসিক এ স্থাপনাটি তিন জেলার মোহনায় অবস্থিত। এর পাশেই চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলা এবং দক্ষিণে নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলা। মসজিদের পেছনে রয়েছে ৩৫ দশমিক ২৯ একর আয়তনের সুবিশাল নাটেশ্বর দীঘি। এর মালিকানা কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ ও চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার বাসিন্দাদের। দীঘির দক্ষিণ-পূর্ব পাড়ে রয়েছে শাহ শরিফ বাগদাদির (রহ.) দরগাহ।


দীঘি ও মাজারকে ঘিরে এখানে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠতে পারে বলে অভিমত স্থানীয়দের।


মজার ব্যাপার হচ্ছে, মসজিদের পাশেই নাটেশ্বর দীঘিটি পড়েছে শাহরাস্তি উপজেলার চিতোষী ইউনিয়নের সর্বশেষ সীমায়। রাজা নাটেশ্বর তার নামানুসারে এ দীঘি খনন করেন। ২৭ একর জমির ওপর দীঘিটি খনন করা হয়। এটি কুমিল্লা জেলার সবচেয়ে বড় দীঘি। আট বছর আগে এলাকাটি অধিগ্রহণ করে পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর।


অত্যন্ত সুন্দর ও নিখুঁত নকশায় টালি ইট ও চুন-সুরকির ওপর খোদাই করে তৈরি করা হয় তিন গম্বুজবিশিষ্ট এই মসজিদ। মসজিদটি বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ৩৬০টি মসজিদের মধ্যে একটি। এ মসজিদকে ঘিরে এলাকাটি হতে পারে একটি পর্যটন কেন্দ্র। এ মসজিদের উত্তর-পশ্চিম কোণে পির শাহ শরিফ হাফেজিয়া মাদ্রাসা ও আয়েশা হালিম এতিমখানা রয়েছে। মসজিদের তত্ত্বাবধান করছেন এ মাদ্রাসার শিক্ষক ও ছাত্ররা।


দীঘিটির দক্ষিণ পাশে রয়েছে বিশাল মাঠ। দীঘিটি কুমিল্লা ও চাঁদপুর এ দুই জেলার সীমান্তবর্তী স্থানে অবস্থিত। দীঘির পশ্চিমপাড়ে ‘রায়েরবাগ’ নামে একটি গ্রাম প্রতিষ্ঠা করেন রাজা নাটেশ্বর। নাটেশ্বর দীঘির পূর্ব-দক্ষিণ কোণে অবস্থিত পির হযরত শাহ শরিফ বাগদাদি (রহ.)-এর মাজার। প্রতি বছর এ মাজারে আয়োজন করা হয় বিশাল ওরস ও ওয়াজ মাহফিলের। মসজিদটির পূর্ব পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ডাকাতিয়া নদী।


দর্শনার্থীদের অভিমত, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এ স্থানগুলো ঘুরে বেড়ালে মনে প্রশান্তি জাগে। এসব পুরোনো কীর্তিগুলো গ্রামের শোভাবর্ধনের পাশাপাশি হয়ে উঠতে পারে একটি পর্যটন স্পট। এলাকাবাসী মনে করে, সরকারের সহায়তা ও প্রচার পেলে শরীফপুর শাহী জামে মসজিদ, দীঘি, মাজার পর্যটকদের কাছে হতে পারে দর্শনীয় স্থান।


অধ্যাপক সরোয়ার জাহান দোলন যুগান্তরকে বলেন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এ স্থানগুলো ঘুরে বেড়ালে মনে প্রশান্তি জাগে। এসব পুরোনো কীর্তিগুলো গ্রামের শোভাবর্ধনের পাশাপাশি হয়ে উঠতে পারে একটি পর্যটন স্পট। এতে সরকারের সহায়তা ও প্রচার পেলে শরীফপুর শাহি জামে মসজিদ, দীঘি, মাজার পর্যটকদের কাছে হতে পারে দর্শনীয় স্থান।

সম্পাদক : অপূর্ব আহমেদ