চলমান শ্রমিক অসন্তোষের কবলে পড়ে গার্মেন্টস শিল্পে দেখা দিয়েছে গভীর সংকট। পোশাক কারখানায় কর্মচারী ও শ্রমিকদের নিরাপত্তা এবং কারখানার সম্পত্তি রক্ষার স্বার্থে ১৩০টি পোশাক কারখানার সব কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত সব ধরণের নতুন নিয়োগ বন্ধ করা হয়েছে। এদিকে পোশাকশ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ১২ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। রোববার রাজধানীর উত্তরায় বিজিএমইএ অফিসে ‘পোশাক শিল্পে ন্যূনতম মজুরি ও বর্তমান শ্রম পরিস্থিতি’ বিষয়ক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানা বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান।
বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, মজুরি বাড়ানোর পরও আন্দোলনের নামে বিভিন্ন জায়গায় কারখানা ভাঙচুর করা হচ্ছে। মজুরি ঘোষণার পর থেকে বেশ কিছু কারখানায় অজ্ঞাতনামা কিছু উচ্ছৃঙ্খল শ্রমিক অযৌক্তিক দাবিতে বেআইনিভাবে কর্মবিরতি পালন করে কর্মকর্তাদের মারধর করেছে।
কারখানার ভেতরে ব্যাপক ভাঙচুর ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতে আশুলিয়া, কাশিমপুর, মিরপুর ও কোনাবাড়ি এলাকার প্রায় ১৩০টি পোশাক কারখানা কারখানা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এসব কারখানার মালিকরা মূলত কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিকদের নিরাপত্তা এবং কারখানার সম্পত্তি রক্ষার স্বার্থে কারখানার সব বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যেসব কারখানার শ্রমিকরা কাজ করতে আগ্রহী সেগুলোতে কাজ চলছে । তাদের কাজ চলমান থাকবে।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, করোনা মহামারির কারণে দেশের মধ্যে ২০২০-২১ সালে বন্ধ হওয়া কারখানার সংখ্যা ৩১৭টি। আর করোনা পরবর্তি সময়ে অন্যান্য কারণে প্রতিযোগী সক্ষমতা ধরে রাখতে না পারার কারণে ২৬০টি কারখানা বন্ধ হয়েছে।
শিল্পের উত্থানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বন্ধ কারখানার সংখ্যাও বাড়ছে। কারখানা বন্ধ হয়েছে নানা সংকটে। এ পর্যন্ত প্রায় ৬৮৮৫টি পোশাক কারখানা বিজিএমইএ এর সদস্যপদ গ্রহণ করলেও কালের পরিক্রমায় ৩৯৬৪টি সদস্য কারখানা বিভিন্ন কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। শুধুমাত্র করোনা মহামারির কারণে ২০২০-২১ সালে বন্ধ হওয়া কারখানার সংখ্যা ৩১৭টি এবং পরবর্তীতে অন্যান্য কারণে প্রতিযোগী সক্ষমতা ধরে রাখতে না পারার কারণে ২৬০টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে বিজিএমইএর পরিচালকরাও উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে দেশের পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা নির্ধারণ করে গেজেট প্রকাশ করেছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। পহেলা ডিসেম্বর থেকে নতুন মজুরি কাঠামো কার্যকর হবে। এ মজুরি হারের ওপর কারও কোনো সুপরিশ বা আপত্তি থাকলে আগামী ১৪ দিনের মধ্যে নিম্নতম মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে লিখিতভাবে জানাতে হবে।
এই সময়সীমার মধ্যে পাওয়া আপত্তি বা সুপারিশ বিবেচনার পর বোর্ড সরকারের কাছে সুপারিশ করবে। রোববার ঢাকার নিম্নতম মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী মোল্লা স্বাক্ষরিত এ গেজেট প্রকাশ করা হয়।
গেজেটে বলা হয়েছে, ন্যূনতম মজুরি সমন্বয় করে এক বছর কর্মরত থাকার পর শ্রমিক-কর্মচারীরা মূল মজুরির ৫ শতাংশ হারে বার্ষিক ভিত্তিতে মজুরি বৃদ্ধি পাবে। পরবর্তী বছরে ক্রমবর্ধমান হারে পুনরায় মূল মজুরির ৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাবে।
সোয়েটারসহ অন্যান্য গার্মেন্টস শিল্প সেক্টরে ফুরন ভিত্তিক মজুরিতে কর্মরত শ্রমিকরাও বার্ষিক ভিত্তিতে মূল মজুরির ৫ শতাংশ হারে মজুরি বৃদ্ধির সুবিধা পাবেন।
শ্রমিক-কর্মচারীদের কর্মঘণ্টা বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এবং বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা ২০১৫ এর সংশ্লিষ্ট ধারা ও বিধি অনুযায়ী নির্ধারিত হবে। শ্রমিক-কর্মচারীরা বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এবং বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা ২০১৫ এর সংশ্লিষ্ট ধারা ও বিধি অনুযায়ী ভাতাদি এবং অন্যান্য সুবিধাদি পাবেন।
গেজেটের তথ্য অনুযায়ী, গ্রেড-১ এর শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি হবে ১৪ হাজার ৭৫০ টাকা। এর মধ্যে মূল মজুরি ৮ হাজার ২০০ টাকা, বাড়ি ভাড়া ৪ হাজার ১০০ টাকা, চিকিৎসা ভাতা ৭৫০ টাকা, যাতায়াত ভাতা ৪৫০ টাকা এবং খাদ্য ভাতা ১ হাজার ২৫০ টাকা।
গ্রেড-২ এর শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি হবে ১৪ হাজার ১৫০ টাকা। এর মধ্যে মূল মজুরি ৭ হাজার ৮০০ টাকা, বাড়ি ভাড়া ৩ হাজার ৯০০ টাকা, চিকিৎসা ভাতা ৭৫০ টাকা, যাতায়াত ভাতা ৪৫০ টাকা এবং খাদ্য ভাতা ১ হাজার ২৫০ টাকা।
গ্রেড-৩ এর শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি হবে ১৩ হাজার ৫৫০ টাকা। এর মধ্যে মূল মজুরি ৭ হাজার ৪০০ টাকা, বাড়ি ভাড়া ৩ হাজার ৭০০ টাকা, চিকিৎসা ভাতা ৭৫০ টাকা, যাতায়াত ভাতা ৪৫০ টাকা এবং খাদ্য ভাতা ১ হাজার ২৫০ টাকা।
গ্রেড-৪ এর শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি হবে ১৩ হাজার ২৫ টাকা। এর মধ্যে মূল মজুরি ৭ হাজার ৫০ টাকা, বাড়ি ভাড়া ৩ হাজার ৫২৫ টাকা, চিকিৎসা ভাতা ৭৫০ টাকা, যাতায়াত ভাতা ৪৫০ টাকা এবং খাদ্য ভাতা ১ হাজার ২৫০ টাকা। একইভাবে গ্রেড-৫ এর শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি হবে ১২ হাজার ৫০০ টাকা। এর মধ্যে মূল মজুরি ৬ হাজার ৭০০ টাকা, বাড়ি ভাড়া ৩ হাজার ৩৫০ টাকা, চিকিৎসা ভাতা ৭৫০ টাকা, যাতায়াত ভাতা ৪৫০ টাকা এবং খাদ্য ভাতা ১ হাজার ২৫০ টাকা।
এর আগে গত ৭ নভেম্বর শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে পোশাক শ্রমিকদের এ নতুন মজুরি ঘোষণা করেন। তার আগে শ্রম ভবনে পোশাক শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণে গঠিত বোর্ডের ষষ্ঠ সভায় এই মজুরি চূড়ান্ত করা হয়। এসময় গার্মেন্টস শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি বর্তমান ৮ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ১২ হাজার ৫শ করার ঘোষণা দেন মন্ত্রী। মজুরি বৃদ্ধির এ হার আগের তুলনায় ৫৬.২৫ শতাংশ বেশি।
এছাড়া শ্রমিকদের জন্য বেতন গ্রেড ৭টি থেকে কমিয়ে ৫টি নির্ধারণ করা হয়। শ্রমিকরা মোট বেতনের ৬৩ শতাংশ পাবেন বেসিক হিসেবে। পাশাপাশি প্রতিটি পরিবার পাবে একটি করে ফ্যামিলি কার্ড।