বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্বের উদ্বেগের কোনও কারণ নেই, বরং পুরোপুরি উৎসবের মেজাজে একটি সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অবাধ নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে – এমন কথাই আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বের প্রায় ৯০টি দেশের রাষ্ট্রদূতকে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রসচিব। শুক্রবার সন্ধ্যায় দিল্লিতে এক বিশেষ ব্রিফিংয়ে এই দেশগুলোর রাষ্ট্রদূত বা শীর্ষ কূটনীতিবিদদের নির্বাচনি পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেন বাংলাদশের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। বাংলাদেশের নির্বাচন সরেজমিনে দেখে যাওয়ার জন্য দেশগুলোকে পর্যবেক্ষক পাঠানোরও অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি, যাতে প্রাথমিকভাবে বহু দেশই ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে।
এই ৯০টি দেশ হলো এমন দেশ, যাদের বাংলাদেশে সরাসরি কোনও দূতাবাস বা মিশন নেই, কিন্তু দিল্লিতে নিযুক্ত তাদের রাষ্ট্রদূতরাই বাংলাদেশ সংক্রান্ত ঘটনাবলি দেখার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। কূটনৈতিক পরিভাষায় এই রাষ্ট্রদূতদেরই বলে ‘কনকারেন্টলি অ্যাক্রিডিটেড’– সোজা কথায় দিল্লিতে নিযুক্ত হলেও বাংলাদেশও তাদের কাজের পরিধিতেই পড়ে। আর এরকমই প্রায় ৯০টি দেশের প্রতিনিধিরা হাজির ছিলেন দিল্লিতে বাংলাদেশ হাই কমিশন প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধু হলে আয়োজিত সেই ব্রিফিংয়ে।
আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে আমেরিকা বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন যে ধরনের ‘অতি-সক্রিয়তা’ দেখাচ্ছে, সেই পটভূমিতে এই ব্রিফিং ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ! বাংলাদেশে বিগত দেড় দশক ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে আর্থসামাজিক উন্নয়নের কর্মকাণ্ড চলছে এবং গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের পরম্পরা বহমান আছে, তাতে দেশের নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগের বা বিচলিত হওয়ার কোনও কারণ নেই– মূলত এই বক্তব্যই ব্রিফিংয়ে তুলে ধরা হয়। পরে শনিবার দুপুরে দিল্লিতে ভারতের সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময়ে মাসুদ বিন মোমেন জানান, ‘আমাদের নির্বাচন নিয়ে যে পারসেপশন (ভাবনা বা দৃষ্টিভঙ্গী) সেটাই আমরা এই দেশগুলোর কাছে তুলে ধরেছি। পরিস্থিতি নিজের চোখে দেখে যেতেও আহ্বান জানিয়েছি। আমাদের নির্বাচন যে পুরোপুরি শান্তিতে ও আনন্দমুখর পরিবেশেই হবে সেটাও তাদের আশ্বস্ত করেছি।’ তবে গত ২৮ অক্টোবর বিরোধী দল বিএনপি’র মহাসমাবেশের পর থেকেই পরিস্থিতিকে ‘বিগড়ে দেয়ার’ যে একটা চেষ্টা চলছে, সেটাও তিনি ওই রাষ্ট্রদূতদের কাছে উল্লেখ করেছেন। ফলে বিরোধী শিবিরের পক্ষ থেকে নির্বাচনি পরিবেশেকে অপ্রীতিকর করে তোলার বা সহিংসতার রাজনীতি শুরু করার যে একটা অপপ্রয়াস আছে, সেটাও কিন্তু বাংলাদেশ তাদের মনে করিয়ে দিতে ভোলেনি।
পররাষ্ট্র সচিব ব্রিফিংয়ে বলেছেন, ‘বিশ্বের আরও বহু গণতান্ত্রিক দেশের মতোই বাংলাদেশেও নির্বাচন কোনও উৎসবের চেয়ে কম নয়। বাংলাদেশের মানুষও ওই উৎসবে শামিল হওয়ার জন্য এবং নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে পছন্দের জনপ্রতিনিধিকে বেছে নেওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছেন। আমাদের নির্বাচন কমিশনও একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য এবং সাধারণ মানুষ যাতে উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দিতে পারে তার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ।
বাংলাদেশের বিগত সাধারণ নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে অতীতে যে ধরনের সমালোচনা হয়েছে তার মোকাবিলাতেই যে ঢাকার এই কূটনৈতিক সক্রিয়তা, তাতে কোনও সংশয় নেই। আর এই ৯০টি দেশের মধ্যে অনেকগুলোই যেহেতু ‘গ্লোবাল সাউথে’র সদস্য, ফলে তথাকথিত উন্নত পশ্চিমা বিশ্বের বাইরেও বাংলাদেশের গণতন্ত্র চর্চা নিয়ে একটি ভিন্ন ন্যারেটিভ তুলে ধরার চেষ্টাও এর মধ্যে অবশ্যই নিহিত ছিল।
রাষ্ট্রদূতদের জন্য এই বিশেষ ব্রিফিংয়ের ঠিক আগে শুক্রবার বিকালে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন ভারতে তার কাউন্টারপার্ট বিনয় মোহন কোয়াটরার সঙ্গে ‘ফরেন অফিস কনসালটেশনে’ মিলিত হন।
দিল্লির হায়দ্রাবাদ হাউসে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক ইস্যুর মধ্যে বছর তিনেক বাদে নির্ধারিত গঙ্গা চুক্তির নবায়ন এবং তিস্তার অমীমাংসিত ইস্যু নিয়েও আলোচনা হয়েছে। এছাড়া ভারত থেকে পেঁয়াজ বা চালের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহ যেন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নিরবচ্ছিন্ন রাখা হয়, ঢাকার পক্ষ থেকে সেই অনুরোধ দিল্লির কাছে আবারও জানানো হয়েছে।
এছাড়া রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসনের বিষয়টিও পররাষ্ট্র সচিব তার দিল্লি সফরে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরেছেন। যে ৯০টি দেশের রাষ্ট্রদূত বা শীর্ষ কূটনীতিবিদরে সঙ্গে তিনি মিলিত হয়েছেন, তাদের দেশগুলোর কাছেও এই শরণার্থী সংকটের বিষয়টি তিনি বিশদভাবে তুলে ধরেন এবং রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতা কামনা করেন।