শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪

বেসরকারি খাতে জ্বালানি তেলে লাভ না লোকসান?

প্রতীকি ছবি

জ্বালানি তেলের আমদানি ও বিক্রিতে বেসরকারি খাতকে যুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জ্বালানি তেলের আমদানি ও বিক্রির বিষয়টি তারা বেসরকারি খাতের জন্য খুলে দেয়ার পরিকল্পনা করছেন।

প্রতিবেশী ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশেই বেসরকারিভাবে জ্বালানি তেল আমদানি ও বিক্রি করার সুযোগ রয়েছে। সেসব দেশে প্রতিদিন বা প্রতি ঘণ্টায় জ্বালানির দর নির্ধারণ করে দেয়া হয়।

আন্ত্মর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দর বৃদ্ধি আর বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা সংকটের কারণে বহুদিন ধরেই জ্বালানি তেলের আমদানি ও বিক্রিতে বেসরকারি খাতকে যুক্ত করার বিষয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা।

বিশেষ করে সাড়ে চারশো কোটি ডলার ঋণ দেয়ার প্রশ্নে আন্ত্মর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ যেসব শর্ত দিয়েছে, তার একটি হচ্ছে জ্বালানি তেলের ওপর থেকে ভর্তুকি কমিয়ে আনা। সেখানে জ্বালানির মূল্য-নির্ধারণ পদ্ধতি বাজারের ওপরেও ছেড়ে দেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। খবর বিবিসির।

দেশে প্রতিদিন ১৩ থেকে ১৪ হাজার মেট্রিক টন ডিজেল ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আমদানি করা ডিজেলের বড় অংশ পরিবহন খাত এবং কৃষিকাজে সেচের কাজে ব্যবহার হয়।

জ্বালানি তেলের জন্য ২০২১ সালে প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছিল সরকার। তবে এই বছর তেলের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি অনেকটাই সমন্বয় করা হয়েছে। তবে আইএমএফ বলছে, মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতির সংস্কার করা হলে জ্বালানি তেলে ভর্তুকি দেয়ার প্রবণতা কমে আসবে।

এখন সেই দিকেই হাঁটছে সরকার। যদিও বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম এই বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থায় পৌঁছেছে। সোমবার ব্রেন্ট ক্রুড অয়েল বিক্রি হয়েছে ৮১.২০ ডলারে।

এদিকে এখন থেকে বিইআরসি বা গণশুনানি ছাড়াই প্রয়োজনে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বর্তমানে সরকারি ব্যবস্থাপনায় জ্বালানি তেল আমদানি, পরিশোধন ও বিক্রি করা হয়ে থাকে। কিন্তু এখন এ ব্যবস্থার সঙ্গে বেসরকারি খাতকে যুক্ত করতে চাইছে সরকার।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারম্নল ইসলাম সোমবার জানিয়েছেন, শুধু ফুয়েল না, এলএনজি বা এলপিজি - এগুলোও প্রাইভেট লেভেলে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা যায় কিনা তা নিয়ে তারা আলোচনা করেছেন।

তিনি বলেছেন, সেক্ষেত্রে দুইটা জিনিস দেখতে হবে। তেল যদি আনেন, বিপিসি ছাড়া আর কেউ তো মার্কেটিং করতে পারে না। সেক্ষেত্রে তারা যে ক্রুড অয়েল আনবে, সেটা রিফাইন করে বিপিসিকে দিয়ে বিক্রি করে দিলে সুবিধা হবে নাকি ওদেরকে কোন একটা কন্ডিশন দিয়ে বিক্রি করতে দেয়ার অনুমতি দেয়া বেটার হবে, এটা দেখে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া যায় কিনা, সেটা দেখার জন্য বলা হয়েছে।

কীভাবে জ্বালানির ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতকে যুক্ত করা যায়, সেজন্য একটি পরিকল্পনা পাঠাতে বলা হয়েছে জ্বালানি মন্ত্রণালয়কে।

খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেছেন, শুধু তেল না, যেকোনো এনার্জি বেসরকারিভাবে আনার জন্য চিন্তা করতে হবে এবং তাদের মার্কেটিং কেমন হবে, সেটাও দেখতে বলা হয়েছে।

তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, বাংলাদেশের একটি শিল্প গ্রুপ বসুন্ধরা বিটুমিন পরিশোধন করার একটি কারখানা তৈরি করেছে। সেই রকম তেল যারা আমদানি করে মার্কেটিং করতে চাইবেন, তাদেরও একইভাবে রিফাইনারি তৈরি করে নিতে হবে।

যাদের লাইসেন্স দেয়া হবে, তাদেরকেই নির্দিষ্ট করে দেয়া হবে যে, কোন দেশ থেকে কতটুকু অপরিশোধিত জ্বালানি তারা আমদানি করতে পারবেন।

তখন রিফাইন (পরিশোধন) করে তারা বিপিসিকেও দিতে পারেন অথবা সরকার অনুমতি দিলে নিজেরাও বিক্রি করতে পারেন। তবে তখন এসব খাতের তেলের মান রিফাইন করার পর পরীক্ষা করে দেখবে বিএসটিআই। কিন্তু বেসরকারি খাতে এই সুযোগ দিলে কী লাভ হবে, জানতে চাওয়া হলে তিনি বলছেন, প্রাইভেট সেক্টরকে যদি আমরা ওপেন করে দেই, তখন দেখা যাবে আমাদের এই অভাবগুলো অনেকটা কমে আসবে। কারণ তাদের ব্যক্তিগতভাবেও অনেক জায়গায় বিনিয়োগ আছে।

বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারতেই বেন্ট ক্রুড অয়েল বা অপরিশোধিত তেলের দর বিবেচনায় পেট্রোল, অকটেন বা ডিজেলের দাম নির্ধারণ করে দেয়া হয়। সেদেশে সরকার ছাড়াও বেসরকারি খাতে কিছু কোম্পানি জ্বালানি তেল আমদানি, পরিশোধন ও বিক্রি করে থাকে।

ভারতের সাংবাদিক কুণাল বসু বলছেন,  ভারতে দামটা ঠিক হয় এভাবে, বিশ্বের যেসব জায়গা থেকে তেল আমদানি করা হয়, তার সঙ্গে সরকারি কর ও মুনাফা যোগ করে প্রতিদিন তেলের দরটা নির্ধারণ করে দেয়া হয়।

প্রতিদিন সরকারের জ্বালানি মন্ত্রণালয় ঠিক করে দেয়, কি দামে ডিজেল-পেট্রোল বিক্রি হবে।  অনেক কিছু বিকেন্দ্রীকরণ করা হলেও এখানে কিন্তু সরকারের কড়া নিয়ন্ত্রণ আছে। আবার আমেরিকায়  প্রতি ঘণ্টায় তেলের দাম নির্ধারণ হয়ে থাকে।

যুক্তরাজ্যে প্রতিদিনই জ্বালানি তেলের দাম ওঠানামা করে। কিন্তু সেখানে সরকারি কোন সংস্থা সেটা নির্ধারণ করে না। ক্রুড অয়েলের দাম, সরকারি কর, ভ্যাট ইত্যাদির সাথে নিজেদের মুনাফা মিলিয়ে পাম্প মালিকরাই প্রতিদিন সেটা ঠিক করেন। ফলে একই দিন একেক এলাকায় তেলের দাম একেক রকমও হতে পারে।

অর্থনীতিবিদরা বরাবরই জ্বালানি তেলের ওপর ভর্তুকি কমানো এবং এটির দর বাজারমূল্যে নির্ধারণের তাগিদ দিয়ে আসছেন। তারা বলেছেন, ভর্তুকিও আসলে জনগণের টাকা থেকেই দিতে হয়। কিন্তু ভর্তুকি কমাতে পারলে সেটা সরকার অন্য খাতে ব্যয় করতে পারবে।

ভারতে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণে সাধারণ ক্রেতাদেরও পর কী প্রভাব পড়ে জানতে চাইলে কুনাল বসু বলছেন, যেহেতু ব্রেন্ট ক্রুডের দাম রোজই পাল্টাতে থাকে, সুতরাং কী দামে কেনা হচ্ছে, দেশে আনা হচ্ছে, সেটার ওপর নির্ভর করে এখানেও দাম রোজ পাল্টাচ্ছে।

এতে আমিও বাজার মূল্যে কিনতে পারছি, আবার সরকারকে এজন্য কোন চাপ নিতে হচ্ছে না। তবে বাংলাদেশের জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম বলেছেন, সরকার যখন জ্বালানি তেল বিক্রি করে, তখন আমরা ধরে নিতে পারি, সরকার সেটা লাভ করার জন্য করে না।

সুতরাং জনগণ যে দামে স্বসিত্ম পাবে, সেই দামেই তাদের দেয়ার কথা। কিন্তু যখন সেটা প্রাইভেট সেক্টরে যাবে, তখন তাদের উদ্দেশ্যই থাকবে ব্যবসা করা বা লাভ করা। সেক্ষেত্রে দামের ওপর তারা একটা নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা করবে। সাধারণ মানুষের সুবিধা তাদের মুল উদ্দেশ্য হবে না। তারা হয়তো নানাভাবে দাম বাড়াতে চাইবে। সেটা সবার জন্য একটা অসুবিধা তৈরি করবে।

বাংলাদেশে অবশ্য অতীতে দেখা গেছে, জ্বালানি তেলের দাম অনেক কমে গেলেও সেখানেও সরকার বেশি মূল্যে বিক্রি করে হাজার হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে। বর্তমানে লিকুইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস বা এলপি গ্যাসের দাম সরকারিভাবে বেঁধে দেয়া হয়। আন্ত্মর্জাতিক বাজারের দর, আমদানি ও পরিবহন খরচ, মুনাফা ইত্যাদি বিবেচনায় রেখে প্রতিমাসে একবার এলপি গ্যাসের  দাম নির্ধারণ করে দেয় নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা।

জ্বালানি তেল আমদানি ও বিক্রিতে বেসরকারি খাত যুক্ত করা হলেও দাম নির্ধারণে এ ধরনের পদ্ধতি অনুসরণ করার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

ড. বদরুল ইমাম বলছেন, ’আমি ঠিক নিশ্চিত নই যে, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মিল রেখে তারা দামটা নির্ধারণ করবে কিনা। আমি মনে করি, এক্ষেত্রে সরকারের একটা নিয়ন্ত্রণ থাকা দরকার, কিছু বাধ্যবাধকতা থাকা দরকার যে, দামটা কীভাবে নির্ধারণ করা হবে।

আসল কথা হলো, প্রাইভেট সেক্টরে গেলেও দামটা যেন তাদের ইচ্ছামতো নির্ধারণ করা না হয়, সেখানে যেন নিয়মনীতি ও নজরদারি থাকে।

সম্পাদক : জোবায়ের আহমেদ নবীন