বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪

৬ ডিসেম্বর মুক্ত হয় ৪ জেলা

৬ ডিসেম্বর মুক্ত হয় ৪ জেলা

১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর বীর মুক্তিযোদ্ধারা ফেনী, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ ও লালমনিরহাটকে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত করেন। ফেনীমুক্তি অভিযানের নেতৃত্ব দেন তৎকালীন মেজর জাফর ইমাম। তার নেতৃত্বে ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনা ও মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা সমগ্র ফেনী মহকুমাকে শত্রুমুক্ত করতে সক্ষম হন। ওই সময়টায় গেরিলা যুদ্ধ ও সম্মুখযুদ্ধের তীব্রতায় দেশের সব রণাঙ্গন ছিল উত্তপ্ত।

গঙ্গাসাগর, সালদা নদী, মন্দভাগ, হিলি, কমলপুর, জামালপুর, সাতক্ষীরা, কানাইঘাট এবং আরও অনেক রণাঙ্গনের মতো ফেনীর বিলোনিয়া রণাঙ্গনও ছিল খুবই তপ্ত একটি রণাঙ্গন।

অধিনায়ক জাফর ইমাম (পরবর্তীতে লে. কর্নেল) বীরবিক্রম তার রচিত ‘দাম দিয়ে কিনেছি এই বাংলা’ শীর্ষক বইতে লিখেছেন, ‘প্রায় ১০০ বর্গমাইলের এই কনক্লেভটির স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্বের কারণে ফেনী-বিলোনিয়া ছিল আমাদের এবং পাকিস্তানিদের জন্য মর্যাদার লড়াই ক্ষেত্র। জুনের প্রথমার্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ জেনারেল আবদুল হামিদ খান এখানে আসেন নিজেই যুদ্ধের দিকনির্দেশনা দিতে।

মিত্রবাহিনীর চার কো-কমান্ডার লে. জেনারেল সগত সিং এবং ২৩ মাউন্টেন ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল আর ডি হীরা বিলোনিয়া দখলের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন ছিলেন। মুক্তিবাহিনীর ছিলেন অপেক্ষাকৃত দুজন অত্যন্ত জুনিয়র অফিসার ২ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ এবং ফেনী-বিলোনিয়া রণক্ষেত্রের টাস্কফোর্স কমান্ডার ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম আর তার সঙ্গী অপরিসীম সাহসী একদল সহযোদ্ধা।

এসব বীর সৈনিক আর গণযোদ্ধারা ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের নেতৃত্বে যে মারাত্মক অভিযান চালান তাতেই পর্যুদস্ত হয় আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী। এ সময় ভারতীয় মিত্রবাহিনীর গোলন্দাজরা সক্রিয় সহযোগিতা দিয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানের ২৪ এফ এফ রেজিমেন্টের সব অফিসার ও সৈনিককে বন্দি করে জাফর ইমামের সামনে হাজির করেন।

তাৎপর্যময় হলো, ২৫ মার্চের কিছুদিন আগে এই ২৪ এফ এফ রেজিমেন্টের একটি ইউনিটে কর্মরত ছিলেন জাফর ইমাম। ফেনী-বিলোনিয়ার প্রচণ্ড যুদ্ধে আরও যারা অংশ নেন তার মধ্যে ছিলেন ক্যাপ্টেন ইমামুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মোকলেসুর রহমান, লে. দিদার, লে. মিজান, ক্যাপ্টেন হেলাল মোরশেদ, ক্যাপ্টেন মজিবুর রহমান ও স্টাফ গোলাম মোস্তফা। বিলোনিয়া যুদ্ধের রণকৌশল ও বীরত্বগাথা এতই চমকপ্রদ যে, তা এখন দেশ-বিদেশের সামরিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবিষয়।

মেহেরপুর : একাত্তরের ২ ডিসেম্বর গাংনী হানাদারমুক্ত হলে শিকারপুরে অবস্থিত মুক্তিবাহিনীর অ্যাকশন ক্যাম্পের ক্যাপ্টেন তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী হাটবোয়ালিয়ায় এসে ঘাঁটি স্থাপন করেন। মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী সম্মিলিতভাবে ৫ ডিসেম্বর মেহেরপুরে প্রবেশ করে। সীমান্তে শত্রুবাহিনীর পুঁতে রাখা অসংখ্য মাইন অপসারণের মধ্য দিয়ে মেহেরপুর পুরোপুরি মুক্ত হয় ৬ ডিসেম্বর। 

জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের উপদেষ্টা আতাউল হাকিম লাল মিয়া বলেন, ‘৫ ডিসেম্বর আমরা রাত আনুমানিক ১২টা/১টার দিকে সুবেদার সামসুল ইসলামের নেতৃত্বে বারাদির পাটকেলপোতা গ্রামে জোর অ্যামবুশ তৈরি করেছিলাম। সেখানে মর্টার দিয়ে কয়েকটি আক্রমণ চালিয়ে শত্রুদের একটি গাড়ি পুড়িয়ে দিই। বাকি গাড়িগুলো আগেই পালিয়ে গিয়েছিল।’

ঝানিইদহ : স্বাধীনতা সংগ্রামে এ দেশে প্রথম যে সম্মুখসমর হয়েছে তা হয়েছিল ঝিনাইদহের বিষয়খালীতে। ঝিনাইদহের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ২ এপ্রিল সদর উপজেলার বিষয়খালী যুদ্ধ, ৪ এপ্রিল শৈলকূপা উপজেলার গাড়াগঞ্জ যুদ্ধ, ৪ আগস্ট আলফাপুর যুদ্ধ, ১৪ অক্টোবর আবাইপুর যুদ্ধ ও ২৬ নভেম্বর কামান্না যুদ্ধ। পাক হানাদাররা যশোর ক্যান্টনমেন্টর দিকে পিছু হটতে বাধ্য হয়।

লালমনিরহাট : মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী এদিন লালমনিরহাট শহরকে তিন দিক থেকে ঘেরাও করে আক্রমণ চালাতে থাকে। একপর্যায়ে শত্রু সেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পরাজয় নিশ্চিত জেনে লালমনিরহাট রেলওয়ে স্টেশন থেকে পাক হানাদার বাহিনী, রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও তাদের দোসর অবাঙালিরা দুটি ট্রেনে চেপে রংপুর ও সৈয়দপুরের দিকে পালিয়ে যায়। ফলে তদানীন্তন লালমনিরহাট মহকুমা হানাদারমুক্ত হয়।

সম্পাদক : জোবায়ের আহমেদ নবীন