সোমালিয়ান দস্যুদের হাতে জিম্মিদশা থেকে মুক্ত ২৩ নাবিকই এমভি আবদুল্লাহর সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাতের পথে রয়েছেন। আগামী ১৯ কিংবা ২০ এপ্রিল জাহাজটি আমিরাতের আল হারমিয়া বন্দরে পৌঁছানোর কথা রয়েছে। এরপরই জানা যাবে, মুক্ত নাবিকদের মধ্যে কারা কারা জাহাজে থাকবেন এবং কারা আবুধাবি থেকে দেশে ফেরত আসবেন। বিষয়টি নিশ্চিত করে কেএসআরএম গ্রুপের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম বলেন, ‘আবুধাবির আল হারমিয়া বন্দরে পৌঁছানোর পর সিদ্ধান্ত হবে, মুক্ত নাবিকদের মধ্যে কারা জাহাজে থাকতে চান, কারা চান না। যারা আবুধাবি থেকে দেশে ফিরতে চাইবেন তাদের যাবতীয় প্রক্রিয়া অনুসরণ করে দেশের আনা হবে।’
এদিকে সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়ে গত ১২ মার্চ মধ্য দুপুরে যে উৎকণ্ঠা শুরু হয়, ৩৩ দিন পর তার অবসান ঘটলো। জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্তি পেল এমভি আবদুল্লাহ আর ২৩ বাংলাদেশি নাবিক। বাংলাদেশ সময় শনিবার রাত ৩টার দিকে এমভি আবদুল্লাহ তার গন্তব্য সংযুক্ত আরব আমিরাতের দিকে রওনা হয়। এরআগে ছোট একটি উড়োজাহাজে করে পরপর তিন ব্যাগ ভর্তি ডলার সমুদ্রে ফেলা হয়। সেগুলো স্পিড বোট দিয়ে সংগ্রহ করে জলদস্যুরা। এরপর রাত ৩টা, একে একে ৬৫ জন জলদস্যু নেমে যায় এমভি আবদুল্লাহ থেকে। নয়টি বোটে করে তারা চলে যায় রাতের আঁধারে। যাবার আগে নাবিকদের উদ্দেশ্যে বলে যায়, “তোমরা এখন মুক্ত"। এর পরপরই এমভি আবদুল্লাহর ক্যাপ্টেন দেশে জাহাজের মালিকপক্ষের কাছে তাদের মুক্তির বার্তা পাঠান।
জাহাজটি ছাড়া পাওয়ার পরপরই কাছাকাছি থাকা ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌবাহিনীর দুটি যুদ্ধজাহাজ এমভি আবদুল্লাহকে নিরাপত্তা দিতে শুরু করে। সোমবার বেলা দুইটায় সংস্থাটির ওয়েবসাইটে এমভি আবদুল্লাহকে পাহারা দিয়ে নেয়ার ছবি প্রকাশ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ছবিতে দেখা যায়, নীল সাগরে এগিয়ে চলছে এমভি আবদুল্লাহ। দুই পাশে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌবাহিনীর দুটি যুদ্ধজাহাজ। এ সময় তিনটি দ্রুতগতির নৌযানকেও টহল দিতে দেখা যায়।
রোববার বিকেলে জানা যায়, সোমালিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য পান্টল্যান্ডের পূর্ব উপকূলে ৮ জন জলদস্যুকে গ্রেপ্তার করেছে সেখানকার পুলিশ। পান্টল্যান্ড পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বরাতে সোমালিয়ার ইংরেজি সংবাদমাধ্যম গেরো জানায়, বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহকে যারা জিম্মি করেছিল, সেই জলদস্যুদের ৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গত ১২ মার্চ সোমালিয়ান জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়ার পর জাহাজের মালিকপক্ষ, বিমা কোম্পানি ও আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারীদের সহযোগিতায় মুক্তিপণের অর্থ পরিশোধ করেই ২৩ নাবিকসহ জাহাজটি মুক্ত করা হয়। এরপরই এমভি আবদুল্লাহ আবুধাবির আল হারমিয়া বন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। তবে জাহাজের মালিকপক্ষ মুক্তিপণ দেয়ার বিষয়ে কোনো কথা বলেননি। এ বিষয়ে মিজানুল ইসলাম বলেন, ‘আন্তর্জাতিক যাবতীয় নিয়ম অনুসরণ করেই ২৩ নাবিকসহ জাহাজটি মুক্ত করা হয়েছে। গতরাতেই জাহাজ থেকে দস্যুরা নেমে গেছেন। জাহাজটি আবুধাবির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। মুক্তিপণের বিষয়টি আমাদের পর্যায়ে নেই।’
এদিকে এমভি আবদুল্লাহ মুক্ত হওয়ার পর ১৪ এপ্রিল দুপুরে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে অবস্থিত কেএসআরএম ভবনে সংবাদ সম্মেলনে করে জাহাজের মালিকপক্ষ। এ সময় প্রতিষ্ঠানটির উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) শাহরিয়ার জাহান রাহাত সাংবাদিকদের বলেন, গত ১২ মার্চ এমভি আবদুল্লাহ দস্যুদের কবলে পড়ে। দস্যুরা অস্ত্রের মুখে জাহাজটি জিম্মি করে সোমালিয়ান উপকূলে নিয়ে যায়।
তিনি বলেন, ‘জাহান মণি’ জাহাজ জলদস্যুর কবলে পড়ার ১৪ বছর পর একই ঘটনা ঘটলো। ঘটনাটি দুর্ভাগ্যজনক। সাধারণত সোমালিয়ান জলদস্যুরা জাহাজ জিম্মি করে অর্থ আদায়ের জন্য। তারা জাহাজের মালিকপক্ষকে টার্গেট করে বেশি স্বার্থ হাসিল করতে চায়। তারা (দস্যুরা) জিম্মির ৯ দিনের মাথায় আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে। আমরা তৃতীয়পক্ষের মাধ্যমে জাহাজ ও নাবিকদের উদ্ধারে আলোচনা শুরু করি। আমাদের জাহাজ হাইরিস্ক এরিয়ার বাইরে ছিল। যে কারণে আমরা আর্ম গার্ড ব্যবহার করিনি।
জাহাজটিকে ২৩ নাবিকসহ দস্যুমুক্ত করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান শাহরিয়ার জাহান। তিনি বলেন, পুরো ঘটনা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কঠোরভাবে মনিটরিং করেছেন। এজন্য তাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। এমভি আবদুল্লাহকে উদ্ধারে বিদেশি যুদ্ধজাহাজ অভিযান চালাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমরা বিষয়টি আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে চেয়েছি। আমাদের কাছে নাবিকদের জীবনের মূল্য অনেক বেশি। যে কারণে আমরা অভিযানে সম্মত ছিলাম না। আমাদের সরকার কুইক রেসপন্স করেছে। পুরো ঘটনায় সাংবাদিকরা সহযোগিতা করেছে। আশা করছি, ১৯-২০ এপ্রিল জাহাজটি আমিরাত পৌঁছাবে। এরপর নাবিকদের দেশে ফিরিয়ে আনাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কেএসআরএমের মালিকানাধীন এসআর শিপিংয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মেহেরুল করিম বলেন, জাহান মণির সময় আমাদের জ্ঞানের অভাব ছিল। তখন উদ্ধারে সময় বেশি লেগেছিল। এবার জাহাজ দস্যুদের কবলে পড়ার পর থেকেই আমরা জাহাজের লোকেশন ট্র্যাক করতে থাকি। যোগাযোগ শুরুর পর প্রতিদিনই দস্যুদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। গত দুদিন আগে আমাদের দাবি অনুযায়ী প্রত্যেক নাবিকের ভিডিও নিয়েছি। মুক্তিপণের প্রতিটি কাজ আইনগতভাবে করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে করা হয়েছে। কত ডলার সে বিষয়টি আমরা নানা কারণে বলতে পারছি না। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সোমালিয়া, কেনিয়ার নিয়ম মানতে হয়েছে।
দেশের প্রতি ভালোবাসার বার্তা: মুক্তি পেয়ে লাল সবুজের জাতীয় পতাকা হাতে এমভি আবদুল্লাহর নাবিকরা প্রিয় স্বদেশ ভূমিকে ভালোবাসার বার্তা দেন। জিম্মিদশা থেকে মুক্তির পর রোববার বেলা ১টা ৪৫ মিনিটের দিকে জাহাজের চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খান ফেইসবুকে প্রথম পোস্ট দেন। তাতে দেখা যায়, জাতীয় পতাকা হাতে নাবিকরা সবাই উচ্ছ্বসিত। মুক্ত এমভি আবদুল্লাহর পাশেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইইউএনএভিএফওআর অপারেশন আটলান্টার একটি যুদ্ধ জাহাজকেও দেখা যাচ্ছিল ছবিতে।
শেষ ছবিতে দেখা যায়, ইইউ নেভির কমান্ডোরা এমভি আবদুল্লাহতে বাংলাদেশি নাবিকদের পাশে অবস্থান নিয়ে আছেন।
ফেইসবুক পোস্টে আতিকুল্লাহ খান লেখেন, “আলহামদুলিল্লাহ, অবিশ্বাস্য প্রচেষ্টার জন্য এসআর শিপিংকে ধন্যবাদ। বন্ধু, পরিবার ও সকল শুভাকাঙ্ক্ষীদের কৃতজ্ঞতা- যারা পুরো যাত্রায় আমাদের জন্য প্রার্থনা করেছেন। ধন্যবাদ ইইউএনএভিএফওআর অপারেশন আটলান্টা। ধন্যবাদ বাংলাদেশ। লাভ ইউ অ্যান্ড মিসিং ইউ বাংলাদেশ।
মুক্তির আনন্দ নাবিকদের পরিবারে: জাহাজের মালিকপক্ষ কবির গ্রুপের মিডিয়া ফোকাল পার্সন মিজানুল ইসলাম বলেন, রাত ৩টার দিকে জাহাজটি সোমালিয়া থেকে আরব আমিরাত রওনা হয়েছে। নাবিকরা সবাই সুস্থ আছেন।
ঘণ্টা খানেকের মধ্যে নাবিকদের মুক্তির খবর দেশে পৌঁছাতেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠেন তাদের পরিবারের সদস্যরা। এক মাস ধরে নাবিকদের নিয়ে স্বজনরা ছিলেন উৎকণ্ঠায়।
এমভি আব্দুল্লাহর ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভীরের মা জ্যোৎস্না বেগম বলেন, ঈদের দিন কথা বলার পর আমার ছেলের সাথে আর কথা হয়নি। রোববার ভোর রাত পৌনে ৪টার দিকে সে ফোন করে মুক্তি পাওয়ার কথা জানিয়েছে। ভোর রাতে মুক্তির খবর পেয়ে কী যে আনন্দ লাগছে তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। মনে হচ্ছে আজকেই আমাদের ঈদ। ঈদের দিনতো আমাদের ঘরে কোনো আনন্দেই ছিল না।
নাবিক আইনুল হকের মা লুৎফে আরা বেগম বলেন, আমার ছেলেরা মুক্ত হয়েছে, কেমন ভালো লাগছে তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। ঈদ গেলেও আমাদের ঘরে কোনো আনন্দ ছিল না। ঈদের দিন আইনুলের সাথে কথা হয়েছিল। তারপর দুই দিন আর কথা হয়নি। খুব শঙ্কায় ছিলাম, ছেলের মুক্তি নিয়ে। আমরা জাহাজ মালিকপক্ষ, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও সাংবাদিকদের প্রতি কৃতজ্ঞ। তারা সবসময় বিষয়টি নজরে রেখেছে বলে আমার ছেলেরা মুক্তি পেয়েছে।