শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪

উপকূলজুড়ে ভেসে উঠেছে ক্ষতচিহ্ন

উপকূলজুড়ে ভেসে উঠেছে ক্ষতচিহ্ন

❏ বিদ্যুৎ নেই ❏ ধ্বসে গেছে বেড়ীবাঁধ ❏ অধিকাংশ এলাকায় সড়ক যোগাযোগ বন্ধ

❏ গাছ ও দেয়াল চাপায় ঝড়েছে ২১ প্রাণ ❏ ৩৯ হরিণের মৃতদেহ উদ্ধার

ঘূণিঝড়ের সময় প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়েছিল উপকূলীয় এলাকার মানুষ। রেমাল তাণ্ডব শেষে কোনোমতে বাড়ি ফিরেই দেখতে পান ক্ষতচিহ্ন। একশ কিলোমিটারের বেশি বাতাসের বেগ নিয়ে ধেয়ে আসা ঝড়ের সঙ্গে জলোচ্ছ্বাস আর ৫ থেকে ৭ ফুট উঁচু বানের তোড়ে ধ্বসে পড়েছে অনেকের ঘর; গাছপালা ভেঙে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঘর, নিচু এলাকার বাড়ি ডুবেছে পানিতে আর ভেসে গেছে মাছের ঘের। উপকূলজুড়ে ভেসে উঠতে শুরু করেছে ঝড়ের রেখে যাওয়া ক্ষত।

ক্রমে প্রবল হয়ে ওঠা এই ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’ এর তাণ্ডবে উপকূলের জেলাগুলো ছাড়াও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের প্রায় এক তৃতীয়াংশ জেলার শতাধিক উপজেলা। ঝড় উপকূল পার হওয়ার সময় জানমালের ব্যাপক ক্ষতি করে গেছে; জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয়েছে বিস্তীর্ণ জনপদ। জোয়ারের সময় ঝড়ের তোপ বাড়িয়েছে ক্ষতি; উপকূলের একের পর এক এলাকায় বেড়িবাধ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে শত শত গ্রাম, ভেসে গেছে মাছের ঘের। সোমবার ঘূর্ণিঝড়ের শেষটায় এবং রোববার উপকূলের কাছাকাছি আসার পর থেকে বানের জলে ভেসে, দেয়াল ও গাছ চাপায়, আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে ছয় জেলায় এক নারী ও শিশুসহ অন্তত ২১ জনের মৃত্যুর খবর এসেছে। দুর্গত অধিকাংশ এলাকায় বন্ধ রয়েছে সড়ক যোগাযোগ। সরকারি হিসাবেই ধ্বংস হয়েছে ৩৫ হাজার বাড়িঘর। এ সময় সুন্দরবনে ৩৯ টি হরিণের মৃহদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।

প্রতিবেশী ভারতেও প্রাণহানির কারণ হয়েছে রেমাল। পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি ঝড়ো বাতাসে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে অন্তত ছয়জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছে কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার।

গত ২২ মে পূর্বমধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন পশ্চিমমধ্য বঙ্গোপসাগর এলাকায় একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হয়, যা ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করে সুস্পষ্ট লঘুচাপ, নিম্নচাপ, গভীর নিম্নচাপ দশা পেরিয়ে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয় শনিবার সন্ধ্যায়। তখন এর নাম দেয়া হয় রেমাল। রোববার সকালে ঘূর্ণিঝড়টি পরিণত হয় প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে। এর প্রভাবে রোববার বিকাল থেকেই উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক বৃষ্টিপাত শুরু হয়। পরদিন সকাল থেকে সারাদেশেই বৃষ্টিপাতের প্রবণতা বেড়ে দুর্বল হয়ে আসে রেমাল। সোমবার ঝড়ের দাপট কমে এলে আশ্রয়কেন্দ্র কিংবা স্বজনদের বাড়ি থেকে যখন তারা নিচু এলাকায় নিজেদের বাড়িতে ফিরেছেন, তখন দেখতে পেয়েছেন বিধ্বস্ত ঘর, ভাঙা বাড়ি। ভেসে গেছে মাছের ঘের, পানির তোড়ে বাধ ভেঙে ডুবে গেছে ফসলের ক্ষেত।

ক্ষতির পাশাপাশি প্রায় দুই দিন থেকে ভোগান্তিও কম ছিল না উপকূলবাসীর। ঝড়ের কারণে বড় বিপর্যয় এড়াতে আগের দিনেই বিদ্যুৎ বন্ধ রাখা হয়েছিল অনেক এলাকায়; অন্ধকারে ডুবে ছিলেন ৩০ লাখ গ্রাহকের পরিবার। ঝড় আঘাত হানার পর থেকে সোমবার রাত পর্যন্ত এ সংখ্যা বেড়ে হয়েছে পৌনে তিন কোটি। বিদ্যুৎহীন অবস্থা সবখানে রাতেই কাটছে না। বিদ্যুৎ না থাকায় আস্তে আস্তে মোবাইল নেটওয়ার্কও বন্ধ হয়ে যায়। ঝড়ের আতঙ্কের মধ্যে স্বজনদের অবস্থা জানতে না পারার উৎকণ্ঠাও সঙ্গী হয়েছিল তাদের। সংবাদ সংগ্রহে ঢাকা থেকে উপকূলের সংবাদকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগেও বেগ পেতে হয়। দীর্ঘ সময়জুড়ে চলা রেমালের তাণ্ডবে রাস্তায় গাছ পড়ে থাকায় অনেক জায়গায় সড়ক যোগাযোগও বন্ধ রয়েছে।

শুধু গ্রাম নয়, জেলা শহর ও নগরী ডুবিয়ে মানুষকে দুর্ভোগের মধ্যে ফেলেছে ঘূর্ণিঝড় রেমাল। বরগুনা জেলা শহরের বঙ্গবন্ধু সড়কের ব্যবসায়ী ইকবাল হোসেন বলেন, এইবারের বন্যায় যেভাবে পানি উঠছে, গত ১০ বছরে কোনো বন্যায় এইভাবে পানি দেখা যায়নি।

বরিশাল নগরীও ডুবেছে বানের পানিতে। নগরীর ব্রাউন্ড কম্পাউন্ড এলাকার বাসিন্দা ফেরদৌস রহমান বলেন, রোববার মাঝরাত থেকে বিদ্যুৎ নেই, মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। রাস্তায় হাঁটু পানি অসহায় অবস্থায় রয়েছি। উপকূলের জেলাগুলোর মত বানের পানিতে না ডুবলেও টানা বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা তৈরি হয় রাজধানী ঢাকার অনেক স্থানে।

উপকূলের জেলাগুলোর মত বানের পানিতে না ডুবলেও টানা বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা তৈরি হয় রাজধানী ঢাকার অনেক স্থানে। ঝড়ে উপকূলের আরেক বড় নগরী খুলনার অবস্থায় শোচনীয়। ভারি বৃষ্টিতে নগরের খুলনার অধিকাংশ সড়ক ও নিম্নাঞ্চল ডুবে গেছে। অনেক বাড়ির নিচতলা ও দোকানঘরও পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, রেমালে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৩৭ লাখ ৫৮ হাজার ৯৬ জন। সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে ৩৫ হাজার ৪৮৩টি এবং আংশিকভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে ১ লাখ ১৪ হাজার ৯৯২টি ঘরবাড়ি। ঝড়ে বিতরণ লাইন লণ্ডভণ্ড হয়ে উপকূলীয় জেলাগুলোতে দুই কোটি ৭০ লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন; এর মধ্যে কেবল পল্লী বিদ্যুতের বিতরণ এলাকায় রয়েছেন ২ কোটি ৬৬ লাখ ২৬ হাজার ৫৫০ জন। ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতের আগে-পরে বিদ্যুৎ না থাকায় ৬৪ জেলার ২২ হাজার মোবাইল সাইট (টাওয়ার) অচল হয়ে পড়েছে। উপকূলীয় জেলাগুলোর পাশাপাশি দেশের মধ্য ও উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতেও অনেক মোবাইল সাইট বন্ধ রয়েছে।

ক্ষতিগ্রস্ত ১৯ জেলা- খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরগুনা, ভোলা, ফেনী, কক্সবাজার, চট্রগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নড়াইল, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর ও যশোর। ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলার সংখ্যা ১০৭ এবং ইউনিয়নের ও পৌরসভা ৯১৪টি। সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, বরগুনাসহ কয়েক জেলায় বেড়িবাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। নিম্নাঞ্চলে পানি ঢুকে প্লাবিত হয়েছে শত শত গ্রাম। খুলনার দাকোপ ও কয়রা এলাকায় অন্তত ২০টি গ্রাম প্লাবিত হওয়ার তথ্য এসেছে। সেই সঙ্গে ভেসে গেছে শতাধিক চিংড়ির ঘের; ভেঙে গেছে কয়েক’শ কাঁচা ঘরবাড়ি ও দোকানপাট।

বন অধিদপ্তরের খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, সুন্দরবনের অধিকাংশ জায়গা নোনাপানিতে ডুবে গেছে। এবং অধিকাংশ জায়গা ৮-১০ ফিট উচ্চতায় পানিতে প্লাবিত হয়েছে। অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি বন্যপ্রাণী মৃতের তথ্যও তুলে ধরেন তিনি। আমরা আশঙ্কা করছি বন্যপ্রাণীবিশেষ করে বাঘ-হরিণ শাবকসহ সব বন্যপ্রাণীরা আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া কিছু অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সেগুলো অ্যাড্রেস করতে আমাদের আরও সময় লাগবে।

খুলনার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. নাজমুল হুসেইন খান বলেন, ৫৫টি পয়েন্টে বাঁধ ভেঙে এবং উপচে পড়া জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে অসংখ্য গ্রাম।

এ জেলার লাখো মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বিধ্বস্ত হয়েছে প্রায় ৭৭ হাজার ৯০৪টি বাড়িঘর। ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৪ লাখ ৫২ হাজার ২০০ মানুষ। এ ছাড়া ফসলের মাঠ, ঘের-পুকুর লোনা পানিতে ভেসে গেছে।

উপকূলীয় জেলা বরগুনা রোববার রাত থেকে বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন। মোবাইল নেটওয়ার্কও বন্ধ হয়ে আছে। রাস্তায় গাছ পড়ে থাকায় অনেক জায়গায় সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।

জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রাথমিকভাবে ২২ হাজার ৫০৪টি ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত এবং ২ লাখ এক হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া জেলার ছয় উপজেলায় অন্তত আটটি পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।

বরগুনা জেলা প্রশাসক মোহা. রফিকুল ইসলাম বলেন, বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন, মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকা এবং রাস্তায় গাছ পড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ থাকায় ক্ষয়ক্ষতির পুরো তথ্য এ মুহূর্তে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে এবারের ঘূর্ণিঝড়ে বরগুনা ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

সরজমিন এবং বিভিন্ন মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আমতলী উপজেলার পশরবুনিয়া, সদর উপজেলার পালের বালিয়াতলী, মাছখালি, জাঙ্গালিয়া, পাতাকাটা, বাওয়ালকর, পাথরঘাটা উপজেলার পদ্মা, রুহিতা, জ্বীনতলা, কাকচিড়া, বামনা উপজেলার রামনা, বেতাগী উপজেলার কালিকাবাড়ী, ঝোপখালীসহ বেড়িবাঁধের একাধিক পয়েন্ট ভেঙে এবং বাঁধ উপচে জোয়ারের পানি লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। এতে ঘর-বাড়ি পানিতে প্লাবিত হয়ে মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছে।

Courtesy: BDNews24

সম্পাদক : জোবায়ের আহমেদ নবীন