ভালো ঘুম শুধু আরামের বিষয় নয়, এটি শরীর ও মনের সুস্থতার জন্য অপরিহার্য। কিন্তু আধুনিক জীবনের ব্যস্ততা, প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহার, দুশ্চিন্তা ও অনিয়মিত জীবনযাত্রা আমাদের ঘুমের স্বাভাবিক ছন্দকে ব্যাহত করছে। ঘুম ঠিক না হলে কাজের গতি কমে যায়, মন খারাপ থাকে এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে। তাই ভালো ঘুম নিশ্চিত করতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানা এবং তা মেনে চলা জরুরি।
১. নির্দিষ্ট ঘুমের রুটিন মেনে চলুন
প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমাতে যান এবং একই সময়ে উঠার চেষ্টা করুন, এমনকি ছুটির দিনেও। এটি আপনার শরীরের ঘুমের অভ্যাস ঠিক থাকবে। যা আপনাকে প্রতিদিন ঘুমাতে এবং জাগতে সাহায্য করবে। একটি নির্দিষ্ট রুটিন মেনে চললে দিনের বেলায় তন্দ্রা বা ঝিমুনিও কমবে। খেয়াল রাখুন, আপনার ঘুমের সময় এমন হওয়া দরকার যাতে রাতে ৭-৮ ঘণ্টা ভালো ঘুম হয়।
২. ঘুমানোর আগে ইলেকট্রনিক ডিভাইস দূরে রাখুন
আপনার ফোনের মতো ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলো থেকে নীল আলো নির্গত হয়, যা আপনার শরীরে মেলাটোনিনের মাত্রা কমিয়ে দিতে পারে। সূর্যের আলো দেখলে আপনি যেমন সজাগ বোধ করেন, এটির প্রভাবও অনেকটা সেরকম। মেলাটোনিন একটি রাসায়নিক যা আপনার ঘুম ও জাগরণ চক্র নিয়ন্ত্রণ করে। যখন এর মাত্রা কমে যায়, তখন ঘুমানো আরও কঠিন হয়ে ওঠে। নীল আলো নির্গতকারী ডিভাইসগুলো আপনার মস্তিষ্ককে সতর্ক রাখে, আর ফোনের নোটিফিকেশন, ভাইব্রেশন বা হঠাৎ জ্বলে ওঠা আলো রাতে ঘুম ভেঙে দিতে পারে। তাই ভালো ঘুমের জন্য ফোন বিছানা থেকে দূরে রাখুন বা বন্ধ করে দিন।
৩. নিয়মিত ব্যায়াম করুন
প্রতিদিন মাত্র ৩০ মিনিটের ব্যায়াম আপনার ঘুমের মান এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্য উন্নত করতে পারে। প্রাকৃতিক আলোর সংস্পর্শে আসা আপনার ঘুমের চক্র নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করবে। তাই বাইরে ব্যায়াম করলে উপকারিতা আরও বাড়ে। যদি বাইরে যেতে না পারেন, চিন্তার কিছু নেই। ঘরে নিয়মিত ব্যায়ামও আপনার ঘুমের উন্নতি করতে সাহায্য করবে।
তবে ঘুমানোর আগে এক বা দুই ঘণ্টার মধ্যে ব্যায়াম করা এড়িয়ে চলুন। এটি আপনার শক্তির মাত্রা এবং শরীরের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে ঘুমানো কঠিন করে তুলতে পারে। দিনের শেষ দিকে যদি কোনো ধরনের শারীরিক কসরত করতে চান, তাহলে স্ট্রেচিং বা যোগব্যায়াম করার চেষ্টা করুন।
৪. ক্যাফেইন কম খান
ক্যাফেইন খাওয়ার পর এর প্রভাব ৩ থেকে ৭ ঘণ্টা পর্যন্ত থাকতে পারে। অর্থাৎ, দুপুরে খাওয়া এক কাপ কফিও আপনাকে রাত পর্যন্ত জাগিয়ে রাখতে পারে। সাধারণত সকালেই চা-কফি খাওয়া ভালো, তবে সবার সহ্যক্ষমতা আলাদা। কেউ হয়তো বিকেল পর্যন্ত খেলেও সমস্যা না হতে পারে, আবার কারও জন্য দুপুরের পরই বন্ধ করে দেওয়া জরুরি। তবে ঘুমের সমস্যা থাকলে ক্যাফেইন একদম কমিয়ে দিন।
৫. ঘুমের জন্য চাই উপযুক্ত পরিবেশ
আপনার ঘুমের জায়গাটি কীভাবে সাজানো, অনেক সময় তার ওপর নির্ভর করে আপনি কেমন ঘুমাবেন। আরামদায়ক তাপমাত্রা, পরিষ্কার ও নরম বিছানা-বালিশ, মৃদু আলো বা অন্ধকারের ব্যবস্থা – এগুলো আপনাকে ঘুমাতে সাহায্য করবে। তবে কারো যদি বিশেষ কোনো শারীরিক সমস্যা থাকে, তার জন্য পৃথক ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।
ঘুমের সমস্যা দূর করার সহজ উপায়
৬. বিছানার ব্যবহার
আপনার বিছানা যদি খুব আরামদায়ক হয়, তাহলে সেখানে বই পড়া, কাজ করা, ফোনে কথা বলা, টিভি দেখা বা অন্য কোনো কাজ করার ইচ্ছা হতে পারে। কিন্তু বিছানা শুধু ঘুমানোর এবং শারীরিক সম্পর্কের জন্য ব্যবহার করাই ভালো। এতে আপনার মস্তিষ্ক বিছানার সঙ্গে ঘুমের সম্পর্ক স্থাপন করে, ফলে ঘুমাতে সুবিধা হয়। ঘুমানোর আগে বই পড়ে অনেকেই রিল্যাক্স করেন, কিন্তু বইও আপনার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে যদি তা মস্তিষ্ককে সচেতন রাখে। তাই বিছানায় যাওয়ার আগে সোফায় বা অন্য কোথাও বই পড়ার চেষ্টা করুন।
৭. ঘুমানোর আগে চাপ কমাতে হবে
যেসব বিষয়ে আপনি চিন্তিত, সেগুলো নিয়ে ভাবলে রাতে ঘুম আসতে সমস্যা হতে পারে। উদ্বেগ যেন আপনাকে জাগিয়ে না রাখে, সেজন্য কিছু নিয়ম মেনে চলতে পারেন। আপনার দুশ্চিন্তাগুলো ঘুমানোর আগে লিখে ফেলুন, এতে সেগুলো মাথা থেকে বেরিয়ে যেতে সাহায্য করবে। যদি কাজের তালিকা আপনাকে চাপ দেয়, সেটাও লিখে ফেলুন। আগামীকাল এবং সপ্তাহের বাকি দিনগুলোর কাজের অগ্রাধিকার ঠিক করুন, তারপর শিথিল হওয়ার চেষ্টা করুন। ঘুমানোর আগে ৫-১০ মিনিট মেডিটেশন করুন, মন শান্ত হবে।
৮. আলো নিয়ন্ত্রণ করে ঘুমের সহজ উপায়
সকালে কিছুক্ষণ রোদে থাকুন, এটা শরীরের ঘুমের সময় ঠিক রাখে। দিনের বেলায় ঘরের লাইট বা জানালার আলোতে থাকুন। সন্ধ্যার পর থেকে টিভি ও মোবাইলের 'নাইট মোড' চালু করুন, এটি নীল আলো কমাবে। শোবার আগে ঘরের লাইট অর্ধেক কমিয়ে দিন বা মৃদু ও হলুদে আলোর বাল্ব ব্যবহার করুন। অপ্রয়োজনীয় লাইট, যেমন- করিডোর ও রান্নাঘরের লাইট, বন্ধ রাখুন। যারা রাতে কাজ করেন, তারা কাজের সময় উজ্জ্বল আলোয় থাকুন, আর দিনে ঘুমানোর সময় ঘর অন্ধকার করে নিন।
৯. শুধু ঘুম পেলেই বিছানায় যান
আপনি যদি ক্লান্ত না হন, তাহলে বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করা এড়িয়ে চলুন। বরং কিছুটা আরামদায়ক কাজ করুন, যতক্ষণ না আপনি ক্লান্ত বোধ করেন, তারপর বিছানায় যান। যদি বিছানায় যাওয়ার ২০ মিনিটের মধ্যে ঘুম না আসে, তাহলে উঠে পড়ুন। ঘুম না আসায় আপনি হতাশ বা চাপ অনুভব করতে পারেন, যা আপনাকে আরও বেশি জাগিয়ে রাখতে পারে। বিছানা থেকে উঠে এমন কিছু করুন যা আপনাকে শিথিল করতে সাহায্য করবে, যেমন সোফায় বই পড়া বা হালকা স্ট্রেচিং করা, যতক্ষণ না আপনি আবার বিছানায় ফিরে যাওয়ার মতো পর্যাপ্ত ক্লান্ত বোধ করেন।
এমন সহজ কিছু অভ্যাস তৈরি করার মাধ্যমে আপনি আপনার ঘুমের রুটিন ঠিক করে ফেলতে পারবেন।
তথ্যসূত্র: হেলথলাইন