❏ যমুনার ভাঙনে নির্ঘুম সিরাজগঞ্জবাসী ❏ তিস্তায় প্রবল স্রোত, কুড়িগ্রামে দেবে গেছে বাঁধ ❏ মধুমতীর ভাঙনে দিশাহারা ফরিদপুরের মানুষ
উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও ভারি বৃষ্টিপাতে বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় উত্তরবঙ্গের অর্ধলক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। একই সঙ্গে পানির তোড়ে বাড়ছে ভাঙন। এর মধ্যে যমুনা নদীর পানি সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে আবার বাড়তে শুরু করেছে। এতে জেলার চৌহালী, এনায়েতপুর ও শাহজাদপুরে নদী তীরবর্তী এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে।
অন্যদিকে কুড়িগ্রামের রাজারহাটের বুড়িরহাটে তিস্তা নদীর প্রবল পানির স্রোতে দেবে গেছে আরসিসি অংশের ৩০ মিটার স্পার। এতে করে ভাঙনের মুখে পড়েছে ভাটির দিকের বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের রামহরি, মেদনী, কালীরমেলাসহ কয়েকটি গ্রামের ঘর-বাড়ি। রোববার সকালে কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ্ আল মামুন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তিনি জানান, পানির তীব্র স্রোতের আঘাতে স্পারটির মাথার অংশে ৩০ মিটার দেবে গেছে। বাকি ৩০ মিটার রক্ষায় বালুভর্তি জিওব্যাগ ফেলানোর কাজ চলছে। ১৯৯৫ সালে নির্মিত আরসিসি স্পারটির দৈর্ঘ্য ৬০ মিটার। এর আগে শনিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে তিস্তা নদীর অংশের ওই স্পারটিতে এ ঘটনা ঘটে।
অন্যদিকে ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলার পাঁচুড়িয়া, বানা ও গোপালপুর ইউনিয়নের মধুমতী নদীর তীরবর্তী গ্রামগুলো ভাঙনের মুখে পড়েছে। ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জরুরি ভিত্তিতে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেললেও ভাঙন কমছে না। এ কারণে ওই এলাকার নদীর তীরের পাঁচ শতাধিক পরিবারের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্ষা মৌসুমের শুরু থেকে নদীপাড়ের দেড় কিলোমিটার অংশে ভাঙনে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন তারা। প্রতিদিনই নদীতে বিলীন হচ্ছে ওই অঞ্চলের মানুষের সম্পদ। ভাঙন রোধে পাউবো সাময়িকভাবে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলছে নদীতে। তবে তা চাহিদার তুলনায় অতি সামান্য।
ওই তিন ইউনিয়নের নদীপাড়ের বাসিন্দা হাবিব মাতুব্বর, করিম শেখ, বিদ্যালয়শিক্ষক ইউসুফ হোসেনসহ বেশ কয়েকজন জানিয়েছেন, পানি বৃদ্ধির সঙ্গে বেড়েছে ভাঙন। তারা বেশ আতঙ্কে আছেন।
সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী রনজিত কুমার সরকার জানান, ভারী বৃষ্টির কারণে যমুনায় পানি বেড়ে নিম্নভূমিগুলো প্লাবিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে অভ্যন্তরীণ নদ-নদীর পানিও বাড়তে শুরু করেছে।
তিনি জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় সিরাজগঞ্জ হার্ড পয়েন্টে যমুনা নদীর পানির সমতল রেকর্ড করা হয়েছে ১২ দশমিক ৬১ মিটার। যা ২৪ ঘণ্টায় ১৭ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ২৯ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অপরদিকে কাজীপুর মেঘাই ঘাট পয়েন্টে যমুনা নদীর পানির সমতল রেকর্ড করা হয়েছে ১৪ দশমিক ৩৭ মিটার। ২৪ ঘণ্টায় ২৩ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৪৩ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এদিকে যমুনায় পানি বাড়ায় শাহজাদপুর উপজেলার খুকনি ইউনিয়নের ব্রাহ্মণগ্রাম ও আরকান্দি গ্রামের অন্তত ২০টি বসতবাড়ি পানিতে ডুরে গেছে। এসব বাড়িঘরের মানুষ উঁচু চৌকিতে শিশুদের নিয়ে বসবাস করছেন। এছাড়া উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের অধিকাংশ নিচু গ্রামগুলি বন্যার পানিতে ভাসছে। অনেক রাস্তাঘাট পানিতে ডুবে গেছে। এতে দুর্ভোগ পেহাতে হচ্ছে স্থানীয়দের।
সদর উপজেলার কাওয়াকোলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জিয়া মুন্সি জানান, পানি বাড়ায় গত কয়েকদিনে এ ইউনিয়নের হাটবয়রা, ছোট কয়রা, দোগাছি ও কাওয়াকোলা গ্রামে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে প্রায় শতাধিক বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সিরাজগঞ্জ ত্রাণ ও পুর্নবাসন কর্মকর্তা আকতারুজ্জামান বলেন, বন্যা ও ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা পাওয়ার পর ত্রাণ সামগ্রী ও নগদ অর্থ বিতরণ করা হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে শুক্রবার থেকে কুড়িগ্রামে তিস্তার পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে করে রাজারহাট উপজেলার বুড়িরহাট এলাকায় তিস্তার বামতীরে নদী শাসনের জন্য নির্মিত ১৫০ মিটার মাটির বাঁধের মাথায় ৩০ মিটার করে দুই অংশে ৬০ মিটার আরসিসি স্পারের ওপর পানির প্রবল চাপ পড়ে। এ চাপ অব্যাহত থাকায় প্রথমে মাথার অংশে ৩০ মিটার স্পার হেলে যায়। পরে রাত সাড়ে ৮টার দিকে তা পানিতে দেবে যায়।
বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের রামহরি এলাকার সাইফুল ইসলাম বলেন, স্পারটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সারারাত দুশ্চিন্তায় ঘুমাতে পারিনি। দ্রুত এটি মেরামত না করা হলে এই এলাকাটি থাকবে না। তিস্তার ভাঙনে বিলীন হবে।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, ১৫০ মিটার বাঁধ ও আরসিসি স্পারের বাকি ৩০ মিটার রক্ষায় রাতদিন কাজ চলমান থাকবে। আশা করছি বাঁধ ও বাকি আরসিসি স্পার রক্ষা করা সম্ভব হবে।
ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গার পাঁচুড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) এস এম মিজানুর রহমান বলেন, বর্ষার শুরু হতেই তার ইউনিয়নে ভাঙন শুরু হয়। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড ভাঙন রোধে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলায় ভাঙনের প্রবণতা কমে এসেছিল। কিন্তু বর্তমানে কাজ বন্ধ থাকায় আবার ভাঙন দেখা দিয়েছে।
বানা ইউপির চেয়ারম্যান হারুন অর রশীদ বলেন, নদীভাঙনের কারণে ইতিমধ্যে ২০০ বিঘা ফসলি জমি বিলীন হয়ে গেছে। তার ইউনিয়নের দিঘল বানা ও আটক বানার পশ্চিম পাড় এবং রুদ্র বানার পূর্ব পাড় ভাঙনের কবলে পড়েছে।
গোপালপুর ইউপির চেয়ারম্যান খান সাইফুল ইসলাম বলেন, ভাঙনের কবলে আছে বাজরা-চরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এলাকায় ভাঙন থাকলেও নদী শান্ত থাকায় এর তীব্রতা কম। তবে পানি কমতে শুরু করলে কী অবস্থা হবে, তা এই মুহূর্তে বলা কঠিন।
ভাঙনের মুখে আছে বাজরা-চরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদালয়। ১৯৯৫ সালে স্থাপিত বিদ্যালয়টিতে ২০১২ সালে নতুন একটি ভবন করা হয়। বিদ্যালয়ে ৬০ জন শিক্ষার্থীতে পড়ানোর জন্য শিক্ষক আছেন পাঁচজন। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফরিদা বেগম বলেন, মধুমতীর ভাঙনের কবলে পড়ে বিদ্যালয়ের টয়লেটটি পশ্চিম দিকে কাত হয়ে পড়েছে। সেটি তালা দিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। তবে ওই টয়লেট ভেঙে পড়লে বিদ্যালয়ের মূল ভবনও ভেঙে যাবে। তিনি বলেন, ‘এ ভাঙনের আতঙ্কে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে আসা কমিয়ে দিয়েছে। নদী ভাঙতে ভাঙতে খালের আকার ধারণ করে বিদ্যালয়ের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে বিপদের মধ্যে আছি।’
পাঁচুড়িয়া ইউনিয়নের বাঁশতলা এলাকার বাসিন্দা কামাল উদ্দিন আহমেদ (৪৬) বলেন, ‘জন্মের পর থেকেই দেখছি মধুমতী নদী ভাঙছে। এখন পর্যন্ত কোনো সরকারই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়নি। কয়েকবার আমরা হারিয়েছি ভিটেমাটি ও ফসলি জমি।’
গোপালপুর ইউনিয়নের কাতলাসুর এলাকার বাসিন্দা ফেরত মাতব্বর (৫৪) বলেন, ওই গ্রামে বড় একটি আশ্রয়ণ প্রকল্প গড়ে তোলা হয়েছে। নদী ভাঙতে ভাঙতে প্রকল্পের ঘরগুলোর ২০০ মিটারের মধ্যে চলে এসেছে। তিনি আরও বলেন, ভাঙন রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন তারা। কাজ না হওয়া পর্যন্ত আর কিছুই বিশ্বাস করেন না।
এদিকে ভাঙন ঠেকাতে জরুরি ভিত্তিতে বিভিন্ন পয়েন্টে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলার কাজ করছে পাউবো। তবে সেগুলো প্রয়োজনের তুলনায় কম। স্থানীয় মানুষের দাবি স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের।
পাউবোর ফরিদপুর কার্যালয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী সন্তোষ কর্মকার বলেন, আলফাডাঙ্গার তিনটি ইউনিয়নে ভাঙন রোধে এ পর্যন্ত ১ লাখ ২০ হাজার বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে। তারপরও ভাঙন রোধ করা যাচ্ছে না। কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, কাজ বন্ধ হয়নি, তবে অনুমতি পেতে বিলম্ব হওয়ায় কাজ চলছে ঢিমেতালে।
সন্তোষ কর্মকার বলেন, যেকোনো মূল্যে বাজরা-চরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নদীতে বিলীন হতে দেবে না পাউবো। পাশাপাশি গোপালপুর ইউনিয়নের চরকাতরাসুর এলাকায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলোর ভাঙন রোধে কাজ করছে পাউবো।