গত সাত মাসে (ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) দেশে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে অন্তত ১১৪টি। এতে নিহত হয়েছেন ১১৯ জন। শুধু যে জনতা মব জাস্টিসের শিকার হচ্ছে তা নয়, বাদ যাচ্ছে না পুলিশ কিংবা বিদেশি নাগরিকেরাও। গত ছয় মাসে দায়িত্ব পালনকালে পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে ২২৫টি।
এ তথ্য মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি ও পুলিশ সদর দপ্তরের। এসব পরিসংখ্যানের বাইরেও সড়কে বিভিন্ন সময় পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে বিরূপ আচরণের ঘটনাও ঘটেছে। অযাচিত আক্রমণের শিকার হয়েছেন দায়িত্বরত অবস্থায়।
গত কয়েক দিনে ঘটা কয়েকটি ঘটনা
গত ১৮ মার্চ রাত ১১টার দিকে রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকায় ধর্ষণের অভিযোগে ‘মব’ তৈরি করে গণপিটুনি দেওয়া হয় এক কিশোরকে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত কিশোরকে আটক করতে ঘটনাস্থলে যায় পুলিশ। তাকে আটক করে পুলিশের গাড়িতে নেওয়ার পথে খিলক্ষেত বাজারে স্থানীয় জনতা পুলিশের গাড়িতে হামলা চালায়। এসময় পুলিশ সদস্যদের লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে জনতা। এ ঘটনায় খিলক্ষেত থানার ইন্সপেক্টর তদন্তসহ আটজন আহত হন।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি রাতে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থানা এলাকার আউটার রিং রোডে মোটরসাইকেল আরোহী দুই যুবককে তল্লাশিচৌকিতে থামার জন্য ইশারা দেন দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য। এর কিছুক্ষণ পর ১০-১৫ জন এসে ‘ভুয়া পুলিশ’ অপবাদ দিয়ে এসআই ইউসুফ আলীকে মারধর শুরু করেন। ছিনিয়ে নেওয়া হয় সঙ্গে থাকা মোবাইল ফোন, মানিব্যাগ ও ওয়াকিটকি।
৩ মার্চ চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার ছনখোলা এলাকায় মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনিতে দুজনকে হত্যা করা হয়। পরদিন ৪ মার্চ মধ্যরাতে মব তৈরি করে রাজধানীর গুলশানে একটি বাসায় তল্লাশির নামে মালামাল তছনছ, ভাঙচুর ও লুটপাট করে একদল লোক।
মবের শিকার হচ্ছেন বিদেশিরাও। রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় গত ৪ মার্চ দিন-দুপুরে মব সৃষ্টি করে আক্রমণের সময় ছিনতাইকারী সন্দেহে দুই ইরানি নাগরিকের ওপর হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এসময় ইরানি দুই নাগরিক আহত হন এবং তাদের কাছ থেকে নগদ অর্থ ও মোবাইল ফোন ছিনতাই করা হয়।
শুধু উপরের ঘটনাগুলো নয়, গত ছয় মাসে পুলিশের ওপর এ ধরনের ২২৫টি হামলা হয়েছে। কোথাও কোথাও হামলা করে আসামি ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটেছে। বেশির ভাগ ঘটনা ঘটানো হয়েছে একদল উচ্ছৃঙ্খল জনতার সংঘবদ্ধ আক্রমণে বা মব তৈরি করে। পুলিশের বাইরে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে সেখানে গণপিটুনিতে মৃত্যু ও লুটপাট বেশি।
৬ মাসে পুলিশের ওপর হামলা ২২৫
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ছয় মাসে দায়িত্ব পালনকালে পুলিশ সদস্যের ওপর হামলার ২২৫টি ঘটনার মধ্যে ৭০টি বড় ধরনের আলোচনা তৈরি করে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ২৪টি, অক্টোবরে ৩৪, নভেম্বরে ৪৯, ডিসেম্বরে ৪৩ এবং চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৩৮ ও ফেব্রুয়ারিতে ৩৭টি হামলার ঘটনা ঘটে।
ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মব তৈরি করে হামলাগুলো করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পেশাদার অপরাধী ও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও মব তৈরিতে ভূমিকা রাখছেন। মব তৈরি করে শুধু পুলিশের ওপরেই হামলা হচ্ছে তা নয়, বরং কোথাও কোথাও সাধারণ মানুষের ওপরও হামলা বা গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সাত মাসে দেশে গণপিটুনির অন্তত ১১৪টি ঘটনায় ১১৯ জন নিহত ও ৭৪ জন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি।
বিরূপ প্রতিক্রিয়া পুলিশে
বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের মব তৈরি এবং হামলার ঘটনায় পুলিশ সদস্যদের মধ্যেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। সরকারের বিভিন্ন পর্যায়েও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সবশেষ গত ১৮ মার্চ রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে এক সভায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে পুলিশ কর্মকর্তারা তাদের বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরেন। সভায় দেশের ৬৪ জেলার পুলিশ সুপার, রেঞ্জ ডিআইজি, মেট্রোপলিটনের কমিশনার ও ক্রাইম বিভাগের উপ-কমিশনাররা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, নামে-বেনামে বিভিন্ন সংগঠনের অহেতুক হস্তক্ষেপে কাজ করতে পারছে না পুলিশ। তবে পুলিশের কাজে যারা বাধা দিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগের নির্দেশনা দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলেন, গণপিটুনিতে হত্যাকাণ্ডের মামলায় শাস্তির নজির নেই বললেই চলে। চুরি-ডাকাতির মতো অপরাধ প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পুরোপুরি সক্রিয় নয়। ফলে অপরাধীদের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ কাজে লাগাচ্ছে আরেক অপরাধী চক্র।
মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবীরা বলছেন, গণপিটুনি বেড়ে যাওয়ার ঘটনা আইনশৃঙ্খলার অবনতির চিত্রকেই তুলে ধরে। আইন প্রয়োগ ও বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থাহীনতার কারণে গণপিটুনির ঘটনা বেড়ে যায়। দিনের পর দিন এসব বাড়লেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা সরকারের পক্ষ থেকে না নেওয়ায় ঘটনা আরও বাড়ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, ‘গণপিটুনি বেড়ে যাওয়ার ঘটনা আইনশৃঙ্খলার অবনতির চিত্রকেই তুলে ধরে। তবে পুলিশ যে মুহূর্তে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, তখনই তাদের ওপর হামলা, হুমকি ও আসামি ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা বাহিনীটিকে নতুন সংকটে ফেলছে।
ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘ বিচার ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। মব বা গণপিটুনিতে জড়িত অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।’
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেন, ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট সরকারের কারণে পুলিশ আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে মানুষের আক্রমণের শিকার হচ্ছে। নাগরিক সমাজের প্রতি আমার অনুরোধ, পুলিশকে আপনারা আবার কাছে টেনে নিন। পুলিশকে কাজ করতে সহায়তা করেন।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছাড়া অভিযান চালানোর অধিকার কারও নেই। মব হচ্ছে এটা অস্বীকার করবো না। মব প্রতিরোধে কাজ করছে সরকার। জনগণকে সচেতন হতে হবে। জনগণ উচ্ছৃঙ্খল হলে তো চলবে না।