পঞ্চগড়ে কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শত বছরের প্রাচীন বেশ কিছু স্থাপনা। পঞ্চ মানে পাঁচ আর গড় মানে রাজ্য। মূলত পাঁচটি রাজ্য মিলেই এই পঞ্চগড় গঠিত হলেও দেশ বিভাগের পর এই পাঁচটি রাজ্যের কয়েকটি এখন ভারতের অংশ। পঞ্চগড় থেকেই বহুল আলোচিত হিমালয়ের কাঞ্চনজঙ্ঘা চূড়া দেখতে পাওয়া যায়। পঞ্চগড়ের পাঁচটি গড় হচ্ছে- ভিতরগড়, মিরগড়, রাজনগড়, হোসেনগড় ও দেবনগড়।
বাংলাদেশ অংশে যে রাজ্য বা গড়গুলো পড়েছে তার মধ্যে দুই শতাধিকের বেশি প্রাচীন স্থাপনা রয়েছে। যা আমাদের দেশের অন্য সব প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করে। এ জেলায় অবস্থিত ভিতরগড় বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ প্রত্নতত্ত্ব দূর্গনগরী। এটি বাংলাদেশের এমন প্রান্তে অবস্থিত যেখান থেকে বাংলাদেশের শুরু।
হিমালয় কন্যাখ্যাত দেশের প্রান্তিক এই জেলায় অবস্থিত প্রাচীন স্থাপনাগুলো হলো- ভিতরগড় প্রত্নতত্ত্বের দূর্গনগরী, পৃথু রাজার মহারাজা দিঘী, মির্জাপুর শাহী মসজিদ, বারো আউলিয়ার মাজার, গোলকধাম মন্দির, জগবন্ধু ঠাকুর বাড়ি, বদেশ্বরী মহাপীঠ মন্দির, তেঁতুলিয়ার কালী মন্দির, পাথরের জাদুঘর (রক্স মিউজিয়াম)।
ভিতরগড় প্রত্নতত্ত্বের দূর্গনগরী: প্রাচীন দূর্গনগরীগুলোর মধ্যে সর্ববৃহৎ দূর্গনগরী ভিতরগড়। পনেরশো বছরের পুরোনো এটি। দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ প্রত্নতত্ত্বের দূর্গনগরী হিসেবে মনে করা হয়। প্রায় ২৫ বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত, যা বাংলাদেশের সব থেকে বড় দুর্গনগরী। এতদিন কালের ধুলোয় ঢাকা পড়েছিলো দূর্গনগরীটি।
ইতিহাসের গর্ত খুঁড়ে এটি আবিস্কার করেন ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের অধ্যাপক ড. শাহনাজ হুসনে জাহান। প্রাচীন এই দূর্গনগরীর মাটির নিচে লুকিয়ে আছে প্রাচীন সভ্যতার অজানা অনেক ইতিহাস, স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ ও মূল্যবান প্রত্নতত্ত্বের নির্দশন। মাটি খুঁড়লেই বেরিয়ে আসে দুর্লভ সব প্রাচীন স্থাপনা। চারটি দেয়াল দিয়ে পরিবেষ্টিত ভিতরগড় দূর্গনগরী বাংলাদেশে অদ্বিতীয়।
এর কিছু অংশ বাংলাদেশের পঞ্চগড়ে, কিছু অংশ ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার অন্তর্গত। দুর্গের ভেতরে অনেকগুলো প্রত্নতত্ত্ব স্থল চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে দীঘি, মন্দির, রাজবাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনা রয়েছে। এখানে বিভিন্ন আসবাবপত্রসহ দেবী মূর্তি পাওয়া গেছে। প্রায় দেড় হাজার বছর আগে এটি নির্মাণ করা হয়েছিল বলে অনুমান করেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা।
ভিতরগড় দূর্গনগরীর বাইরের আবেষ্টনীর উত্তরাংশ, উত্তর-পশ্চিমাংশ এবং উত্তর-পূর্বাংশ বর্তমানে ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার অন্তর্গত হওয়ায় ধারণা করা হয়, ৬ষ্ঠ শতকের শেষে কিংবা সপ্তম শতকের শুরুতে ভিতরগড় একটি স্বাধীন রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং প্রাচীন বাণিজ্য সড়ক ও নদীপথের উপর অবস্থিত হওয়ায় ভিতরগড় এলাকার অধিবাসীরা সম্ভবত নেপাল, ভূটান, সিকিম, আসাম, কুচবিহার, তিব্বত, চীন, বিহার, এবং পশ্চিম ও দক্ষিণ বাংলার সঙ্গে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বজায় রেখেছিল।
পৃথু রাজার মহারাজা দিঘী: এই দূর্গনগরীর অভ্যন্তরেই রয়েছে মহারাজা দীঘি। মহারাজা দীঘির ইট বাঁধানো দশটি ঘাট এবং ঘাটের উভয় পাশে ইট ও মাটি দিয়ে নির্মিত সুউচ্চ পাড় নৈসর্গিক দৃশ্যের এক অসাধারণ নিদর্শন। পৃথু রাজের রাজপ্রাসাদ ছিল।
এর পাশেই বর্তমান যে দীঘি, তা মহারাজার দীঘি নামে পরিচিত। পৃথু রাজার খনন করা এই ‘মহারাজার দীঘি’টি বিশাল আয়তনের একটি পুকুর বা জলাশয়। অনেক গভীর হওয়ায় এর পানি অনেক স্বচ্ছ।
কথিত আছে, পৃথু রাজা এক দিন কীচক নামক এক নিম্ন শ্রেণীর লোকের মাধ্যমে আক্রমণের শিকার হন। তখন তিনি ধর্ম নাশের ভয়ে এই দীঘিতে আত্মহনন করেছিলেন। প্রতিবছর নববর্ষের সময় ‘মহারাজার দীঘি’র পাড়ে মেলা বসে। এই মেলায় মাঝে মাঝে ভারত থেকেও দর্শনার্থী আসেন।
মির্জাপুর শাহী মসজিদ: প্রাচীন স্থাপত্যের আরেকটি নিদর্শন হলো- ঐতিহাসিক শাহী মসজিদ। ১৬৫৬ সালে নির্মিত এ ঐতিহাসিক মসজিদটি অবস্থিত পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নে।
বলা হয়, প্রত্নতাত্বিক নিদর্শনগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। প্রায় সাড়ে ৩০০ বছরের পুরোনো। আয়তকার মসজিদটির দৈর্ঘ্য ৪০ ফুট ও প্রস্থ ২৪ ফুট। মসজিদের ছাদে পাশাপাশি ৩টি গম্বুজ এবং চারকোণে ৪টি চিকন মিনার আছে। ভেতরে প্রবেশের জন্য মসজিদের সামনের দেয়ালে আছে ৩টি দরজা। প্রত্যেক দেয়াল ও দরজায় বিভিন্ন কারুকার্যের নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদের গায়ে টেরাকোটা ফুল ও লতাপাতার নকশা খোদায় করা আছে, যার একটির সাথে অন্যটির কোনো সাদৃশ্য নেই। নির্মাণ শৈলীর নিপুণতা, দৃষ্টিনন্দন কারুকার্য ও তিনটি গম্বুজ এই মসজিদের মূল আকর্ষণ।
১৬৭৯ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত হাইকোর্ট প্রাঙ্গণের মসজিদ ও মির্জাপুর শাহী মসজিদের নির্মাণ শৈলীতে যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে। মসজিদটির মধ্যবর্তী দরজার উপরে একটি ফলক রয়েছে, যেখানে ফার্সি ভাষায় রয়েছে নির্মাণ সম্পর্কিত তথ্য। প্রত্নতাত্বিকদের ধারণা, মোঘল সম্রাট শাহ আলমের রাজত্বকালে মসজিদটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়।
বর্তমানে মির্জাপুর শাহী মসজিদ বাংলাদেশ প্রত্নতত্ব বিভাগের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। এছাড়াও প্রাচীন নিদর্শন ও প্রত্নতত্ব সম্পদের মধ্যে পাহাড়ার ডাঙ্গায় ‘ছাপড়াঝাড় মসজিদ’, সর্দারপাড়ায় ‘তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ’ ও মির্জাপুর গ্রামে ‘ইমাম বাড়া’ উল্লেখযোগ্য ।
বারো আউলিয়ার মাজার: পঞ্চগড়ের আটোয়ারিতেই আরেক প্রাচীন স্থান সুফী সাধকের বারো আউলিয়া মাজার। বার আউলিয়াদের আগমনের ইতিহাস বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেলেও ওলীদের ইতিহাস রহস্যাবৃত্ত।
চট্টগ্রাম শহর থেকে ১২ জন সুফি সাধক এখানে এসে বসবাসের পর থেকেই জায়গাটি বার আউলিয়া নামে প্রসিদ্ধ হয়ে উঠে। সুলতানী আমলে ১২ জন ওলী খাজাবাবার নির্দেশে চট্রগ্রামসহ পূর্ব বঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থান গড়ে তুলে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। পরে স্থল পথে রওয়ানা হয়ে ইসলাম প্রচার করতে করতে উত্তরবঙ্গের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছান এবং মির্জাপুর ইউনিয়নের বার আউলিয়ায় আস্তানা গড়ে তুলে ইসলাম প্রচার শুরু করেন।
আটোয়ারির মাটিকে পূর্ণ ভূমিতে পরিণত করার পর সময়ের বিবর্তনে ওলীদের এখানেই সমাহিত করা হয়। গড়ে উঠে বার আউলিয়ার মাজার শরীফ। প্রতি বছর বৈশাখ মাসের শেষ বৃহস্পতিবার বারো আউলিয়ার মাজার প্রাঙ্গণে ওরসের অয়োজন করা হয়।
মন্দিরটি ছয় কোণ বিশিষ্ট একটি স্থাপনা। এটি গ্রীক স্থাপত্যশৈলীর আদলে নির্মিত, যা এখন বিলুপ্ত প্রায়। অষ্টাদশ শতকের এ মন্দিরটি বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।