অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে বিএনপিতেই বিস্ময় দেখা দিয়েছে। এ ব্যাপারে দলের নেতাকর্মীরা নিশ্চুপ হয়ে আছেন। সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করে বিএনপির নেতাকর্মীদের আদালতে হাজিরা না-দেয়া কিংবা সরকারকে সব ধরনের ট্যাক্স, খাজনা, ইউটিলিটি বিল এবং অন্যান্য প্রদেয় স্থগিত করার যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, সেসব বিষয় দলের ভেতরেই অনেককে বিস্মিত করেছে। হুট করে সরাসরি অসহযোগের মতো কর্মসূচি ঘোষণাটি ‘সময় আসার আগেই’ হয়ে গেছে কি-না তা নিয়ে দলটির ভেতরে ও বাইরে চলছে নানা আলোচনা।
দলের বিভিন্ন পর্যায়ে একাধিক নেতা জানিয়েছেন, সাধারণত সরকারবিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচি যাদের সাথে আলোচনা করে চূড়ান্ত করা হয় অসহযোগ কর্মসূচির ক্ষেত্রে সেটি হয়নি। বরং এটি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান একক সিদ্ধান্তেই লন্ডন থেকে ঘোষণা করেছেন।
যদিও তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত দলটির আইন বিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল বলছেন, কর্মসূচি যথাসময়েই এসেছে বলে তারা মনে করেন।
দলটির আইন বিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল আরও বলেন, অসহযোগের কর্মসূচির ঘোষণার পর তা বাস্তবায়নে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতেও আলাদা কর্মসূচি দেয়া হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি ধীরে ধীরে জনগণ সরকারকে অসহযোগিতার এই ‘সিভিল কর্মসূচি’টি পালন করতে শুরু করবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. রাশেদা রওনক খান অবশ্য বলছেন রাজনীতির মাঠে নিজেদের অবস্থান জানান দেয়ার জন্য বিএনপি হয়তো এমন কর্মসূচি দিয়ে চমক দিতে চেয়েছে।
তিনি বলেন, এটি সত্যি আদালতে হাজিরা না দেয়া বা কর, বিল, খাজনা না দেয়ার বিষয়গুলো বাস্তবসম্মত নয়। বিএনপি হয়তো রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে দিয়েছে। তবে দেশে থাকা দলটির নেতাকর্মী ও সমর্থকদের জন্য এসব বিষয় এড়িয়ে চলা সহজ কাজ হবে না।
প্রসঙ্গত, গত বুধবার বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এক ভিডিও বার্তার মাধ্যমে অসহযোগের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। পরে তাকে উদ্ধৃত করে দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে কর্মসূচিটির আবার ঘোষণা দেন।
এদিকে, বিএনপির মাঠ পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতা এ প্রসঙ্গে কথা বলেছেন। নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে মানিকগঞ্জের একজন বিএনপি নেতা বলেন, নেতারা কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। কীভাবে বাস্তবায়ন হবে তারাই বলতে পারবেন। তবে এখনি অসহযোগ না দিয়ে তার আগে সবার কারাবরণ কর্মসূচি দিলে তা বেশি কাজে লাগতো। আমাদের অসংখ্য নেতা কর্মী জেলে। আমরাও যেতাম। একযোগে কারাবরণ করতাম। এখন কর খাজনা কিংবা বিল না দিয়ে কয়জন পরিস্থিতি সামলাতে পারবে?
বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে যে ধারণা পাওয়া গেছে, তা হলো এই কর্মসূচি অনেকটাই এককভাবে লন্ডন থেকে এসেছে। ঢাকায় দলের নেতাদের ধারণা ছিলো ধীরে ধীরে এমন কর্মসূচির দিকেই হয়তো দল যাবে কিন্তু সেটি এতো দ্রুত ও হুট করেই ঘোষণা করা হবে সেটি তারা ভাবেননি।
এমনকি বিএনপির সঙ্গে যেসব দল ও জোট অনেকদিন ধরেই যুগপৎ আন্দোলনে আছেন তাদের কেউ কেউ আগে থেকে জানলেও অনেকেই বিষয়টি ঘোষণার পর জেনেছেন। তবে বিএনপির কেউ কেউ বলছেন অসহযোগ, পরিষেবা বিল কিংবা ট্যাক্স বা খাজনা দেয়ার বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে বললেও এসব বিষয়ে কিছু কৌশল আছে। যেমন বিএনপির ঘোষণায় জনগণকে উদ্দেশ করে বলা হয়েছে, ব্যাংকগুলো এই অবৈধ সরকারের লুটপাটের অন্যতম মাধ্যম। সুতরাং, ব্যাংকে টাকা জমা রাখা নিরাপদ কি না সেটি ভাবুন। তবে প্রকৃত তথ্য হলো- বিএনপির সিনিয়র নেতাদের মধ্যে ব্যাংক মালিক-পরিচালকও আছেন। এছাড়াও দলের নেতাদের অনেকেই প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। তাদের পক্ষে ব্যাংক এড়িয়ে চলা অনেকটাই অসম্ভব। এর বাইরে দলটির মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরাও ব্যাংকে টাকা জমা রাখা থেকে বিরত থাকার ক্ষেত্রে কতটা সাড়া দেবেন, সে প্রশ্ন আছে দলের ভেতরেই।
কায়সার কামাল বলছেন, এটি বলা হয়েছে কারণ দেশের মানুষ ব্যাংকগুলো ও অর্থনীতির ভয়াবহ চিত্র সম্পর্কে অবগত। সে কারণেই আমরা সতর্ক করে বলেছি যে এখন এসব ব্যাংকে মানুষ তার কষ্টার্জিত টাকা রাখবে কি না সেটা যেন তারা ভেবে দেখে।
আবার বিএনপির ঘোষণায় তাদের ভাষায় ‘মিথ্যা ও গায়েবি মামলায়’ অভিযুক্ত রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও অন্যদের আদালতে মামলায় হাজিরা দেয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো- ওই ঘোষণার পরদিন বৃহস্পতিবারও নিম্ন আদালতে ২০১২ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে দায়ের করা বিভিন্ন মামলায় দলটির অনেক নেতাকর্মী হাজিরা দিয়েছেন।
কায়সার কামাল এ প্রসঙ্গে বলেন, সবাই এখন জানে তারা আর ন্যায় বিচার পাবে না এ সরকারের আমলে। আমাদের বহু নেতাকর্মী কারাগারে, অনেককে একতরফাভাবে সাজা দেয়া হয়েছে। তাই হাজিরা দিয়ে লাভ কী? বিএনপি সেটিই বলতে চেয়েছে। সূত্র: বিবিসি।