মঙ্গলবার, ২৬ আগস্ট, ২০২৫

রমনা পার্ক: নগরজীবনে সবুজে মোড়ানো একটুখানি স্বস্তি

রমনা পার্ক: নগরজীবনে সবুজে মোড়ানো একটুখানি স্বস্তি

ঢাকার কোলাহল, যানজট আর কংক্রিটের জঙ্গল থেকে কিছুটা শান্তি খুঁজতে চাইলে নগরবাসীর প্রথম পছন্দ রমনা পার্ক। প্রায় দুশো বছরের পুরোনো এই পার্ক এখনো ঢাকার অন্যতম বৃহৎ ও ঐতিহ্যবাহী বিনোদনকেন্দ্র। শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত হওয়ায় প্রতিদিন হাজারো মানুষ এখানে আসেন হাঁটতে, শরীর চর্চা করতে কিংবা শুধু সবুজের ছায়ায় কিছুটা সময় কাটাতে।

ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ পরিবেশে রমনা পার্ককে অনেকেই ‘শহরের ফুসফুস’ বলে থাকেন। প্রায় ৬৮ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত এই পার্কে রয়েছে বিশাল বৃক্ষরাজি। প্রায় ৭১ প্রজাতির গাছ, ৩৬ প্রজাতির ঝোপঝাড়, ৩৩ প্রজাতির ঔষধি গাছ এবং বহু প্রজাতির পাখি এখানে আশ্রয় নিয়েছে। সবুজের এ আধারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ভিন্নতর জীবনধারা, ভোর থেকে রাত পর্যন্ত পার্কে মানুষের পদচারণায় মুখরিত থাকে।


রমনা পার্কের ইতিহাস

রমনা পার্কের ইতিহাস মুঘল আমল পর্যন্ত প্রসারিত। তখন এই এলাকা ছিল ঘন অরণ্য। ১৯ শতকের শুরুর দিকে ব্রিটিশরা এখানে একটি বাগানবাড়ি ও খেলার মাঠ গড়ে তোলে। ধীরে ধীরে এটি আধুনিক বিনোদনকেন্দ্রে রূপ নেয়। ১৯৪৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এর নামকরণ হয় ‘রমনা পার্ক’।

স্বাধীনতার পর থেকে পার্কটি জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে ওঠে। প্রতি বছর বাংলা নববর্ষের সকালে হাজারো মানুষ এখানে সমবেত হয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানায়। চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কবিতা পাঠ ও নাটক, সবকিছু মিলিয়ে রমনা এখন ঢাকার সংস্কৃতির এক প্রাণকেন্দ্র।

পার্কে বেড়াতে আসা একজন সাংস্কৃতিক কর্মী বললেন, ‘ঢাকা শহরে রমনা পার্ক শুধু সবুজতার প্রতীক নয়, এ জায়গা আমাদের সংস্কৃতিরও প্রতীক। এখানে দাঁড়িয়ে আমরা স্বাধীনতা আন্দোলনের স্মৃতি, নববর্ষের আনন্দ আর সামাজিক ঐক্যের স্পর্শ পাই।’


ভোর থেকে রাত: বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন চিত্র

ভোরের দিকে পার্কে ঢুকলে দেখা যায়, কেউ জগার্স পরে দৌড়াচ্ছেন, কেউ ব্যায়াম করছেন, আবার কেউ যোগব্যায়াম গ্রুপে যোগ দিয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে এখানে গড়ে উঠেছে কয়েকটি নিয়মিত জগিং ক্লাবও। সকাল শেষে অফিস শুরুর আগে কিংবা বিকেলে পরিবার নিয়ে এখানে ভিড় জমে। শিশুরা দৌড়ঝাঁপ করে, বয়স্করা ঘাসে বসে গল্প করেন।

বিকেলের দিকে পরিবেশ আরও বদলে যায়। শিক্ষার্থীরা দল বেঁধে আসে, তরুণ-তরুণীরা আড্ডা দেয়, কেউ ছবি তোলে, কেউ আবার নীরবে বই হাতে পড়ে। গাছতলায় বই হাতে পড়ছেন অনেকে, আর অচেনা কোনো কবিতায় হারিয়ে গেছেন। রমনা বইপ্রেমীদের জন্য এক প্রিয় জায়গা হয়ে উঠেছে। পার্কের নীরবতা এবং সবুজ আবরণ সত্যিই বইপ্রেমীদের জন্য এক বিশ্রামের জায়গা। অনেকে বলেন, পার্কের গাছতলায় বসে বই পড়ার আনন্দ ঘরের চার দেয়ালে পাওয়া যায় না।


লেকের নতুন আকর্ষণ: নৌকাবিহার

রমনা পার্কের মাঝখানে অবস্থিত লেকটি দীর্ঘদিন ধরেই দর্শনার্থীদের প্রিয় জায়গা। সম্প্রতি লেকে চালু হয়েছে ছোট ছোট প্যাডেল বোট। এতে দর্শনার্থীদের বিনোদনের সুযোগ আরও বেড়েছে।

দেখা গেছে, পরিবার, তরুণ-তরুণী এমনকি বয়স্করাও দম ফেলার অবসর পাচ্ছেন এই বোটে চড়ে। কেউ ছবি তুলছেন, কেউ আবার ধীরগতিতে জলে ভেসে বেড়াচ্ছেন। শিশুদের হাসি-আনন্দে চারপাশ মুখরিত হয়ে উঠছে।

একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী বললেন, ‘বোট চালু হওয়ায় এখন এখানে আসা আরও আনন্দদায়ক হয়েছে। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডার পাশাপাশি কিছুটা অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ পাওয়া যায়। অনেক দিন পর পানির মধ্যে বসে ঢাকার সবুজ দেখতে পাচ্ছি, মনটাই ফ্রেশ হয়ে গেল।’


পার্ক ঘিরে কর্মসংস্থান

রমনা পার্কের এক বিশেষ চিত্র হলো ভ্রাম্যমাণ হকারদের উপস্থিতি। বাচ্চাদের জন্য খেলনা, বেলুন কিংবা বাদাম, ঝালমুড়ি, আইসক্রিম থেকে শুরু করে নানা ধরনের খাবার বিক্রি করেন তারা। এতে দর্শনার্থীরা সহজেই বিনোদনের পাশাপাশি হালকা খাবার পাচ্ছেন।

আবার কেউ ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলে দিয়ে উপার্জন করছেন। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ডিএসএলআর ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে দেওয়ার ব্যবসা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

প্রশাসন মাঝে মাঝে অভিযান চালিয়ে হকার সরালেও দর্শনার্থীদের চাহিদার কারণে তারা আবারও ফিরে আসেন। সন্ধ্যার পর বাদামওয়ালার ডাকে কিংবা ঝালমুড়ির টুংটাং আওয়াজে পুরো পার্ক যেন ভিন্ন আবহ পায়।


ঈদ-পার্বনে রমনা পার্ক

ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা কিংবা অন্যান্য উৎসবের দিন রমনা পার্ক হয়ে ওঠে উৎসবমুখর। সকাল থেকেই নতুন জামাকাপড় পরা পরিবারগুলো এখানে ভিড় জমায়। শিশুরা বেলুন ও খেলনা নিয়ে দৌড়ায়, বড়রা ছবি তোলে, অনেকেই একসঙ্গে খোলা আকাশের নিচে খাবার খেতে বসেন।

প্রতি ঈদে রাজধানীর অনেক পরিবার যারা কর্মব্যস্ততায় গ্রামে যেতে পারে না, তারা রমনায় এসে সময় কাটায়। পার্ক ঘিরে তখন অস্থায়ীভাবে বেড়ে যায় হকারদের ব্যবসাও। আইসক্রিম, ফুচকা, জিলাপি, ঝালমুড়ি সবই পাওয়া যায়। ঈদকে ঘিরে নিরাপত্তা জোরদার করতে পুলিশ বিশেষ টহল দেয়।


নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনা

রমনা পার্কে এখন নিরাপত্তার জন্য সিসিটিভি ক্যামেরা ও পুলিশের টহল ব্যবস্থা রয়েছে। তবে দর্শনার্থীদের অভিযোগ, বিশেষ উৎসবে ভিড় বেড়ে গেলে শৃঙ্খলা রক্ষা কঠিন হয়ে পড়ে। বাংলা নববর্ষ বা জাতীয় দিবসে পার্কে প্রবেশে দীর্ঘ সারি তৈরি হয়, পার্কিং সমস্যা ও যানজট ভোগান্তি বাড়ায়।


নগরায়ণের চাপে অস্তিত্বের লড়াই

সবুজের এই স্বর্গরাজ্যকে ঘিরে আছে নানা আশঙ্কা। পার্কের চারপাশে ক্রমবর্ধমান নগরায়ণ, যানবাহনের শব্দদূষণ ও ধুলাবালু পরিবেশ নষ্ট করছে। মাঝে মধ্যে অব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তাহীনতা এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়েও অভিযোগ শোনা যায়।

পরিবেশবাদীদের দাবি, নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যা না হলে এই ঐতিহ্যবাহী পার্ক তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হারাতে পারে। তাদের ভাষায়, ‘রমনা বাঁচলে ঢাকা বাঁচবে। নগরের মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে এই সবুজ ফুসফুসকে রক্ষা করা জরুরি।’

সরকারি নিয়ম অনুযায়ী রমনা পার্ক প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত খোলা থাকে। তবে ভোরবেলায় যারা হাঁটা বা ব্যায়াম করেন, তাদের সুবিধার জন্য কখনো কখনো আরও আগে গেট খোলা হয়। রাত গভীর হওয়ার আগেই অবশ্য পার্ক খালি করে দেওয়া হয় নিরাপত্তার স্বার্থে।

তবু প্রতিদিন হাজারো মানুষের পদচারণায় রমনা পার্ক এখনো জেগে আছে নতুন উদ্যমে। শহরের ব্যস্ততা থেকে সামান্য সময়ের জন্য হলেও মানুষ এখানে এসে শান্তির স্বাদ পান।

রমনা পার্ক শুধু একটি সবুজ জায়গা নয়; এটি ঢাকার মানুষের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের ভরসাস্থল। নতুন সংযোজিত নৌকাবিহার, ভ্রাম্যমাণ হকারদের জমজমাট উপস্থিতি, ঈদে উৎসবমুখরতা, সাংস্কৃতিক আসর আর সবুজের স্বস্তি সব মিলিয়ে রমনা পার্ক আজও নগরবাসীর প্রাণের জায়গা।

সম্পাদক : অপূর্ব আহমেদ