তুরাগ তীরে আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হলো ৫৬তম বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব। আখেরি মোনাজাতের সময় ‘আমিন, আল্লাহুম্মা আমিন’ ধ্বনিতে তুরাগ তীর মুখরিত হয়ে ওঠে। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় লাখ লাখ মুসল্লি আকুতি জানান। বাংলাদেশ ও বিশ্ব শান্তির জন্য দোয়া করেন। রোববার দুপুর সোয়া ১২টার দিকে আখেরি মোনাজাত শুরু হয়ে ১২টা ৪৪ মিনিটে শেষ হয়। আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করেন ইজতেমায় আদি তাবলিগের শীর্ষ মুরব্বি দিল্লির মাওলানা সাদ কান্ধলভীর বড় ছেলে মাওলানা ইউসুফ বিন স্বাদ কান্ধলভী।
এর আগে তিনিই হেদায়েতী বয়ান করেন। বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বের মিডিয়া সমন্বয়কারী মো. সায়েম জানান, রোববার সকালে বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বের মুরুব্বি ও আয়োজক কমিটির ফয়সালা মোতাবেক দুপুর ১২টা ১৫ মিনিটে আখেরি মোনাজাত শুরু হয়। পরে দুপুর ১২টা ৪৪ মিনিটে শেষ হয়।
মোনাজাতে বিশ্ব শান্তি, সারা দুনিয়ার মুসলিমদের পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব, পরিপূর্ণ হেদায়েত ও আল্লাহর সব হুকুম মানা আর নবী করীম (সা.)-এর দেখানো পথে জীবন পরিচালনা করার তৌফিকের জন্য আল্লাহর দরবারে আকুতি জানানো হয়। মোনাজাতে আল্লাহর কাছে নিজেদের অন্তরের খাহেশাত মুক্ত, রাগকে বশ, নাফরমানিকে ঘৃণা ও ভালোবাসা ছড়িয়ে বিশ্ব মুসলিম ভাতৃত্ব গড়া ও দ্বীনের জন্য নিজেদের কবুল করার বিশেষ আর্জি জানানো হয়। এর আগে বাদ ফজর বয়ান করেন ভারতের মাওলানা মুরসালিন। আর হেদায়তি বয়ান করেন মাওলানা ইউসুফ বিন সাদ কান্ধলভী। তাদের বয়ান বাংলায় তরজমা করবেন মাওলানা জিয়া বিন কাসিম।
আখেরি মোনাজাতে ঈমানি জিন্দেগী, ঈমানি মৃত্যু, উত্তম আখলাক ও ঈমানি হাকিকত বুঝার তৌফিক, অন্তরে আল্লাহর ভয় ও মহব্বত সৃষ্টি, সারা জীবনের গোনাহ মুক্তি, উত্তম রিজিক, দুনিয়া ও আখিরাতের কামিয়াবি, পৃথিবীর মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ, ঈমানি ভ্রাতৃত্ব মজবুত করা ও সারা বিশ্বের সকল মানুষের জন্য আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ চাওয়া হয়। বিশ্ব ইজতেমার উত্তর পাশে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের কন্ট্রোলরুমে বসে আখেরি মোনাজাতে অংশগ্রহণ করেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী এড. আ.ক.ম মোজাম্মেল হক এমপি, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আলহাজ্ব মো. জাহিদ আহসান রাসেল এমপি, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরন, গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোল্যা নজরুল ইসলামসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যবৃন্দ।
এদিকে বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে সকাল থেকেই আশপাশের বিভিন্ন জেলা থেকে ধর্মপ্রাণ মানুষজন ইজতেমায় মাঠে আসেন। লাখো মানুষে মুখরিত তুরাগ তীরে অনেকে পৌঁছাতে না পেরে রাস্তাতেই মোনাজাতে অংশ নেন। অনেকেই আবার খোলা মাঠে, যানবাহনে, বহুতল ভবন ও বাসার ছাদে থেকে আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন।
মেট্রোরেলে খুশি ইজতেমার মুসল্লিরা: আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব শেষ হলো রবিবার মুসল্লিদের যাতায়াতের সুবিধা করে দিতে প্রথমবারের মতো মেট্রোরেল ৯ ঘণ্টা চলাচল করেছে।
রোববার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত যাত্রী পরিবহন করেছে মেট্রোরেল। ইজতেমায় আসা-যাওয়ায় বাড়তি সুবিধা পেয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন যাত্রীরা। রবিবার দুপুরে মেট্রোরেলের আগারগাঁও স্টেশনে কথা হয় বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাত শেষে বাড়ি ফিরতে থাকা যাত্রীদের সঙ্গে। তাদের অনেকেই বলেন, বিগত বছরগুলোয় ইজতেমার শেষ দিন মোনাজাতে অংশগ্রহণ করতে যাওয়া ও ফেরাটা অনেক কষ্টসাধ্য বিষয় ছিল। শেষ দিনে রাস্তায় গণপরিবহন থাকতো না বলে কুড়িল বিশ্বরোড থেকেই হেঁটে টঙ্গী পর্যন্ত যেতো হতো।
আসতেও একই ভোগান্তিতে পড়তে হতো তাদের। কিন্তু এবার মেট্রোরেল চালু হওয়াই সেই ভোগান্তি একেবারেই দূর হয়ে গেছে। মোনাজাত শেষ করে ছোট সন্তানকে নিয়ে বাড়ি ফেরা মুসল্লি আমিরুল হোসেন বলেন, ‘আমার ছেলেটা আগে থেকেই আবদার করছিল ইজতেমায় যাওয়ার। এর আগের বছর কষ্ট হবে বলে সঙ্গে নেইনি। মেট্রোরেল চালু হওয়ায় তাকে নিয়ে যাওয়ার সাহস করেছি। সুবিধাও পেয়েছি। তেমন কোনো কষ্ট হয়নি।’ প্রথমবার মেট্রোরেল চড়া ও ইজতেমায় যাওয়ায় ছেলে আহনাফ হোসেন দ্বিগুণ খুশি বলেও জানান বাবা আমিরুল হোসেন। মেট্রোরেল চড়ার অভিজ্ঞতার কথা জিজ্ঞেস করলে উচ্ছ্বসিত হয়ে ‘ভালো’ বলেই হাসতে থাকে আহনাফ।
ইজতেমার মোনাজাত শেষ করে ফেরা মিরপুর-১৪-এর বাসিন্দা সুরুজ মিয়া বলেন, ‘আমি প্রত্যেক বছরই ইজতেমায় যাই। কিন্ত এবার এত আরামে আসা-যাওয়া করছি বিশ্বাসী হচ্ছে না। উত্তরা স্টেশনে নেমেই একটা অটো নিয়ে সরাসরি মাঠে (ইজতেমা) চলে যাই।’ মেট্রোরেল সুবিধার কারণে সময় ও শ্রম দুটিই বেঁচে গেছে মন্তব্য করে ইজতেমার মোনাজাত শেষ করে ফেরা চাকরিজীবী কবির বলেন, ‘মেট্রোরেলে সহজে ইজতেমায় যাওয়া-আসাটা একটা বিস্ময়ের মতো লেগেছে আমার কাছে। আগের বছরগুলোয় হেঁটে যাওয়া-আসা করার কারণে সারা দিন লেগে যেতো। আর পরিশ্রম তো ছিলই। এখন ১০ মিনিটেই উত্তরা। ওখান থেকে সহজেই অটোরিকশায় ইজতেমার ময়দানে। সময়ও বাঁচলো, কষ্টও হলো না।’
ইজতেমায় যাওয়া-আসা করা অনেক মুসল্লি আজই প্রথমবারের মতো মেট্রোরেলে চড়ার অভিজ্ঞতা নেন। সেই সঙ্গে সহজেই ইজতেমায় পৌঁছানোর অভিজ্ঞতা হওয়াই সবাই আনন্দের অনুভূতি প্রকাশ করেন। মেট্রোরেল চলাচলের সময় বাড়ায় শুধু ইজতেমার মুসল্লিরাই নন, সুবিধা পাচ্ছেন মেট্রোতে চড়তে আসা আগ্রহী যাত্রী ও নিয়মিত যাত্রীরাও।
উল্লেখ্য, গত ২৮ ডিসেম্বর দেশের প্রথম মেট্রোরেল বা এমআরটি লাইন-৬-এর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর পরদিন ২৯ ডিসেম্বর থেকে সাধারণ যাত্রী পরিবহন শুরু করে মেট্রোরেল। শুরুতে সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত মেট্রোরেল যাত্রী পরিবহন করছে। এখন চলছে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত। আর ২৫ জানুয়ারি থেকে মেট্রোরেল পল্লবী স্টেশনেও থামবে। ওইদিন থেকে পল্লবী স্টেশন খুলে দেয়া হবে।