মাগুরার হাজরাপুরের লিচু শুধু একটি মৌসুমি ফল নয়—এটি একদিকে যেমন এলাকার কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিকে চাঙা করার একটি সম্ভাবনাময় হাতিয়ার; অন্যদিকে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়ার মাধ্যমে এর বাণিজ্যিক গুরুত্ব বহুগুণে বেড়ে গেছে। হাজরাপুরের লিচু দীর্ঘদিন ধরে টসটসে রসালো, স্বাদ এবং গুণগত মানের জন্য স্থানীয়ভাবে পরিচিত হলেও জিআই স্বীকৃতির মাধ্যমে এটি এখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে একটি স্বতন্ত্র পরিচয় পেয়েছে। এই স্বীকৃতি মূলত প্রমাণ করে, হাজরাপুর অঞ্চলের ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, আবহাওয়া এবং স্থানীয় কৃষি-পদ্ধতির সম্মিলনে উৎপন্ন লিচু অন্য যে কোনো অঞ্চলের লিচু থেকে স্বতন্ত্র এবং উৎকৃষ্ট। ফলে এখন এই লিচুকে কেন্দ্র করে একটি পূর্ণাঙ্গ বাণিজ্যিক চেইন গড়ে তোলার বিশাল সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
জিআই স্বীকৃতির অন্যতম বড় সুবিধা হলো এর মাধ্যমে পণ্যের কদর ও দাম বৃদ্ধি পায়। সেটি বাজারে একটি নির্ভরযোগ্য ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। হাজরাপুরের লিচুর ক্ষেত্রে এর সম্ভাবনা আরও উজ্জ্বল। কারণ বাংলাদেশসহ উপমহাদেশে লিচুর বিপুল চাহিদা রয়েছে। জিআই পণ্য হিসেবে এটিকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা গেলে তা গ্রাহকের মধ্যে আস্থা ও আকর্ষণ তৈরি করবে। ঢাকার সুপারশপ, কৃষিপণ্য বাজার ও পাঁচ তারকা হোটেলে হাজরাপুরের লিচু পৌঁছাতে পারলে অধিক দামে বিক্রি করা সম্ভব। এখান থেকে কৃষকদের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করা যাবে এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের নিয়ন্ত্রণে এনে একটি টেকসই বিক্রয় ব্যবস্থা গড়ে তোলা যাবে। এতে শুধু উৎপাদকই লাভবান হবেন না বরং স্থানীয় পরিবহন, প্যাকেজিং, হিমায়ন ও সরবরাহ চেইনসহ সংশ্লিষ্ট অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থান ও আয় সৃষ্টি হবে।
রপ্তানির ক্ষেত্রেও হাজরাপুরের লিচু একটি সম্ভাবনার নাম। বর্তমানে প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে সীমিত পরিসরে লিচু মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য রপ্তানি করা হয়। জিআই পণ্যের ট্যাগ যুক্ত হলে আন্তর্জাতিক বাজারে এই লিচুর গ্রহণযোগ্যতা বহুগুণে বাড়বে। বিদেশি আমদানিকারকরা জিআই পণ্যে বেশি আগ্রহী হন। কারণ এটি মান, উৎপত্তি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। তাই হাজরাপুরের লিচুকে যদি আন্তর্জাতিক সনদপ্রাপ্ত উৎপাদন ও প্যাকেজিং প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রস্তুত করা যায়, তাহলে এটি অধিক লাভে বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা সম্ভব। এখানে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগের সুযোগও রয়েছে। বিশেষ করে হিমায়িত লিচু, লিচুর জ্যাম-জেলি বা পানীয় জাতীয় প্রক্রিয়াজাত পণ্য তৈরি করে এগ্রো-ফুড শিল্প গড়ে তোলা যেতে পারে।
তবে এই সম্ভাবনাকে বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা। প্রথমত, সংশ্লিষ্ট কৃষকদের রেজিস্ট্রেশন, প্রশিক্ষণ এবং মান নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। জিআই লোগো ব্যবহারের নীতিমালা প্রণয়ন করে শুধু নিবন্ধিত উৎপাদকদের তা ব্যবহারের অনুমতি দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্যাকেজিং ও লজিস্টিক উন্নয়ন অপরিহার্য, যাতে পণ্যের তাজা অবস্থান দীর্ঘ সময় ধরে বজায় থাকে এবং ক্ষতির হার কমে। তৃতীয়ত, বিপণন কৌশল হিসেবে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, ই-কমার্স ও সোশ্যাল মিডিয়াকে কাজে লাগাতে হবে। যাতে দেশের বাইরে থাকা বাঙালিরাও অনলাইনে অর্ডার করতে পারেন। স্থানীয় পর্যায়ে মেলা কিংবা ‘লিচু উৎসব’ আয়োজন করে পর্যটন এবং বিক্রয় বাড়ানো যায়।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এ উদ্যোগে জেলা প্রশাসন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, শিল্প মন্ত্রণালয়, বেসরকারি উদ্যোক্তা ও মিডিয়াকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। একটি অভিজ্ঞ পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিযুক্ত করে বাজার গবেষণা, ব্র্যান্ডিং এবং রপ্তানি নীতি প্রণয়ন করা যেতে পারে। কারণ জিআই সনদ শুধুই সম্মানের নয়। এটি একটি দায়বদ্ধতা, যা সঠিকভাবে ব্যবহার করা গেলে একটি জেলার অর্থনীতিকে বদলে দিতে পারে। হাজরাপুরের লিচুর বাণিজ্যিক সম্ভাবনা শুধু কল্পনা নয়, এটি একটি বাস্তব সম্ভাবনা। যার কার্যকর বাস্তবায়ন মাগুরাকে দেশের অন্যতম কৃষিভিত্তিক ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে।